আবু সাবেত: শুক্রবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে ইলন মাস্ক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর মধ্যে এক উত্তপ্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকের বিস্ফোরক তথ্য ফাঁস হয়েছে। এই তর্ক-বিতর্ক মূলত পররাষ্ট্র দপ্তরের বাজেট কর্তনের ইস্যু নিয়ে হয়েছিল যা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত নীতির ওপর নতুন করে আলো ফেলছে।
প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় মাস্ককে অন্তর্ভুক্ত করা অনেক মন্ত্রিসভা সদস্যের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস আরও জানিয়েছে যে, মাস্কের সাথে পরিবহনমন্ত্রী শন ডাফি ও ভেটেরান্স অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি ডগ কলিন্সের সঙ্গেও উত্তেজনা রয়েছে, যদিও সেগুলি তুলনামূলকভাবে কম উত্তেজনাপূর্ণ।
তবে ব্যক্তিগত বিরোধের বাইরেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো মাস্ক ও তার তথাকথিত ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি (ডোজ)’-এর নেতৃত্বে সরকারী ব্যয়ের ব্যাপক কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত।
ট্রাম্প প্রশাসন এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও ছাঁটাইয়ের ব্যাপকতা ও কঠোর বাস্তবায়ন কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ডেমোক্র্যাটরা মাস্কের এই নীতি নিয়ে সমালোচনা করছেন—বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এমন দপ্তরগুলোর বাজেট কাটছেন যা লাখো আমেরিকানের জীবনযাত্রার ওপর নির্ভর করে। যদিও তারা স্বীকার করছেন যে সরকারি ব্যয়ে কিছু অপচয় রয়েছে।
ডোজ -এর এই র্যাডিক্যাল সংস্কার উদ্যোগের পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের আরও কিছু নীতিগত পরিবর্তন বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে, যেমন শুল্কনীতি। ট্রাম্প সম্প্রতি মেক্সিকো ও কানাডার উপর শুল্ক আরোপ করেছেন, পরে অটোমোবাইল শিল্পের জন্য শুল্ক থেকে ছাড় দিয়েছেন, এবং অবশেষে কানাডিয়ান লাকড়ি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই অস্থির নীতিগুলো বিনিয়োগ বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই শেয়ারবাজার নিম্নমুখী। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ৫% কমেছে, আর প্রযুক্তি নির্ভর নাসডাক সূচক ৭% কমেছে।
তবে এসব আর্থিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াও, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান আরও বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের প্রতি সহায়তা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের জন্য কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে রাজি কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন।
তবে, মাস্ক ও রুবিওর উত্তপ্ত বিতর্কই আপাতত ওয়াশিংটনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাস্ক রুবিওকে আক্রমণ করে বলেন যে, তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘কাউকেই’ বরখাস্ত করেননি। উত্তরে রুবিও বলেন, ১৫০০ জন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, এবং মাস্ক কি চান যে তিনি তাদের আবার নিয়োগ দিয়ে পরে মাস্ক নিজেই তাদের ছাঁটাই করবেন? মাস্ক এরপর রুবিওকে ‘টিভিতে ভালো’ বলে কটাক্ষ করেন, যার স্পষ্ট অর্থ হলো তিনি অন্য কোনো কাজের জন্য ততটা দক্ষ নন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুক্ষণ বিতর্ক চলতে দেন পরে হস্তক্ষেপ করে রুবিওকে সমর্থন জানান।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট পরে এ বিষয়ে মন্তব্য করে জানান যে, ‘মন্ত্রিসভা বৈঠক খুবই সফল ও কার্যকর ছিল, এবং সবাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনকে আরও দক্ষ করার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করছে।’
ট্রাম্পও পরে ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এলন ও মার্কো দারুণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, এবং তারা উভয়েই চমৎকার কাজ করছে। কোনো বিরোধ নেই।’
তবে মাস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ ও তার অভ্যন্তরীণ প্রভাব নিয়ে ট্রাম্প কিছুটা চিন্তিত বলেই মনে হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে বৃহস্পতিবার দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প জানিয়েছেন, প্রশাসন ‘কুড়াল’ দিয়ে নয় বরং ‘সার্জিক্যাল স্ক্যালপেল’ দিয়ে সরকারি সংস্কার করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি ব্যয় অবশ্যই হ্রাস করা দরকার, তবে দক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রাখা জরুরি।’
এই মন্তব্য মাস্কের ক্ষমতার ওপর কিছুটা সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়। তবে মাস্ক বিতর্ক যাই হোক না কেন, ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি হলো অর্থনৈতিক মন্দা।
নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র ৩১% আমেরিকান ট্রাম্পের জীবনযাত্রার ব্যয় সামলানোর নীতিতে সন্তুষ্ট। শুক্রবার প্রকাশিত নতুন কর্মসংস্থান প্রতিবেদনও হতাশাজনক—ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ১,৫১,০০০ নতুন চাকরি তৈরি হয়েছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে কম। বেকারত্বের হার সামান্য বেড়ে ৪.১% হয়েছে।
টার্গেট ও বেষ্ট বাই -এর মতো খুচরা বিক্রেতাদের সিইও-রা সতর্ক করেছেন যে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
মোট কথা, মাস্কের বিতর্কিত ভূমিকা ছাড়াও, ট্রাম্প প্রশাসনের বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো—বেকারত্ব বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারের পতন ও অস্থির শুল্কনীতি।
ট্রাম্পের বর্তমান শক্ত অবস্থান থাকা সত্ত্বেও, এসব চ্যালেঞ্জ তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম