Home কলাম আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে কিলমার গার্সিয়ার নির্মম বাস্তবতা

আমেরিকার অভিবাসন নীতিতে কিলমার গার্সিয়ার নির্মম বাস্তবতা

ভুলে তাড়ানো, আইনে আটকে পড়া

by bnbanglapress
Published: Updated:
A+A-
Reset

 

ছাবেদ সাথী
একটি রাষ্ট্র তখনই তার শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয়, যখন সে দুর্বলতম নাগরিক বা অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষেও দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কিলমার আব্রেগো গার্সিয়ার ঘটনাটি যেন উল্টো এক বাস্তবতার প্রতিচিত্র—যেখানে রাষ্ট্র ভুল করে, দায় স্বীকার করেও নিষ্ঠুরতা থেকে সরতে চায় না।
আব্রেগো গার্সিয়া নামটি হয়তো অধিকাংশ আমেরিকান নাগরিকের কাছে অপরিচিত। কিন্তু তার জীবনগাঁথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের একটি প্রতীক। এক দশকেরও বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস, একটি পরিবার, শ্রমজীবী জীবন—এসবকিছুর পর তাকে শুধু সন্দেহের বশে একদিন তুলে নেওয়া হয়, বলা হয় তিনি এমএস-১৩ গ্যাংয়ের সদস্য। অথচ কোনো প্রমাণ নেই, মামলা নেই, এমনকি পুলিশের অভিযোগপত্রও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টি নোম জানিয়েছেন, এল সালভাদরের কুখ্যাত এক কারাগার থেকে কিলমার আব্রেগো গার্সিয়াকে যদি যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো হয়, তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার করা হবে।
২৯ বছর বয়সী আব্রেগো গার্সিয়া গত সাত সপ্তাহ ধরে তার নিজ দেশ এল সালভাদরে কারাবন্দি রয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন তাকে এমএস-১৩ গ্যাং সদস্য বলে অভিযোগ তুলে ভুলবশত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে। মঙ্গলবার সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোম বলেন, গার্সিয়াকে ফেরত পাঠানো সম্পূর্ণভাবে এল সালভাদরের ওপর নির্ভর করছে।
আব্রেগো গার্সিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি একজন এল সালভাদরের নাগরিক। তিনি নিজ দেশের মাটিতে অবস্থান করছেন। যদি তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা হয়, তবে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই আবারও তাকে বহিষ্কার করব,” নোম বলেন।
তিনি আরও বলেন, এই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আওতাধীন নন, তিনি আমাদের নাগরিকও নন। তিনি নিজ দেশে, নিজ ঘরে রয়েছেন। এখন তার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা এল সালভাদরের উপর নির্ভর করে।
এদিকে, এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে জানিয়েছেন, তিনি আব্রেগো গার্সিয়াকে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা রাখেন না। তিনি বলেন, ‘একজন সন্ত্রাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে চোরাইপথে ফেরত পাঠানো অবাস্তব ও অযৌক্তিক।
আদালতের নথি অনুযায়ী, আব্রেগো গার্সিয়া প্রায় ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, এসময় তিনি নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন এবং সেখানে তার স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাবি করেন, ২০১৯ সালে মেরিল্যান্ড পুলিশ তাকে এমএস-১৩ গ্যাং সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করার পরই তাকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও গার্সিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা কখনোই দায়ের হয়নি।
একজন মার্কিন অভিবাসন বিচারক পরবর্তীতে রায় দেন যে, গার্সিয়াকে বহিষ্কার না করা হোক, কারণ তার নিজের দেশে স্থানীয় গ্যাংদের হাতে নির্যাতনের আশঙ্কা রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন তার বহিষ্কারের ঘটনাকে “প্রশাসনিক ভুল” হিসেবে অভিহিত করলেও, তারা তাকে এমএস-১৩ সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা থেকে সরে আসেনি।
মার্কিন ফেডারেল বিচারক পাউলা জিনিস বুধবার পুনরায় ট্রাম্প প্রশাসনকে নির্দেশ দেন, আব্রেগো গার্সিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে তারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে হবে।
মেরিল্যান্ডের এই বিচারক প্রশাসনকে নির্দেশ দেন মে মাসের মধ্যে শপথনামা জমা দিতে, যাতে স্পষ্ট হয় তারা তাকে ফিরিয়ে আনতে কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনকে ৪ এপ্রিল আব্রেগো গার্সিয়াকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরপর ১০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টও রায় দেয় যে, তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আসে ২০১৯ সালে, মেরিল্যান্ড পুলিশের পক্ষ থেকে। ট্রাম্প প্রশাসন সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে তাড়িয়ে দেয়, যদিও একজন অভিবাসন বিচারক রায় দিয়েছিলেন, গার্সিয়াকে ফেরত পাঠানো হলে তিনি সেখানে গ্যাং সহিংসতার শিকার হতে পারেন। তারপরও তাকে ফেরত পাঠানো হয়। পরে ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকার করে—এটি একটি “প্রশাসনিক ভুল” ছিল।
তবে এখানেই থেমে থাকেনি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট দু’বার নির্দেশ দেয় তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু বর্তমান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সচিব ক্রিস্টি নোম সাফ জানিয়ে দেন, “তিনি আমাদের নাগরিক নন। যদি ফেরত আসেন, আমরা আবার তাড়িয়ে দেবো।” এটি শুধু অমানবিক নয়, আদালতের আদেশের বিরোধিতাও বটে।
আমরা যদি ভেবে নিই, এক ব্যক্তি যিনি ১৪ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করেছেন, শ্রম দিয়ে অর্থনীতি গড়েছেন, পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছেন—তার সব কিছুকে একটি প্রশাসনিক ভুলই ছিন্ন করে দিতে পারে, তাহলে প্রশ্ন জাগে: কারা নিরাপদ এই রাষ্ট্রে? কোন ‘আইন’ এভাবে ‘মানবতা’কে পেছনে ফেলতে পারে?

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়:

১. আইনের শাসন বনাম নির্বাহী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা যদি কারও ফিরে আসার নির্দেশ দেয়, কিন্তু প্রশাসন রাজনৈতিক বিবেচনায় তাকে ফিরিয়ে আনার পথে বাধা দেয়, তবে তা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন। আদালত অবমাননার দায় কি শুধু সাধারণ নাগরিকের জন্য?

২. অভিবাসন নীতি কি ন্যায়ের মাপকাঠিতে দাঁড়ায়?
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি অনেক সময় ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র ছদ্মবেশে বর্ণবাদ, পক্ষপাত ও ভয়ভীতির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। গার্সিয়ার ঘটনা সেই নীতিরই একটি উৎকট উদাহরণ।

৩. মানবিকতার সংকট এবং নৈতিক দ্বিধা
গার্সিয়া কোনো অপরাধ করেননি, অথচ তিনি কারাবন্দি। তার স্ত্রী ও সন্তানরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। একটি দেশ যখন নিজস্ব ভুল শুধরানোর চেষ্টাও করে না, তখন তা কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—তা এক মানবিক পাপ।

আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রকে মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতীক হিসেবে দেখি, তাদের জন্য এই ঘটনা গভীর হতাশার। গার্সিয়ার মতো লোকদের পাশে দাঁড়ানো শুধু একটি নৈতিক কর্তব্য নয়, এটি আমাদের গণতন্ত্রের পরীক্ষাও।

যদি রাষ্ট্র নিজেই তার ভুল শোধরাতে না চায়, তবে সেখানে ন্যায়বিচার শুধুই আইনি নথির মধ্যে বন্দি থেকে যায়। গার্সিয়ার মতো মানুষরা তখন আমাদের সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধ কতটা সত্য, সেটার আয়না হয়ে দাঁড়ায়।

ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি পর্যবেক্ষক

[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

বিপি।এসএম

 

You may also like

Leave a Comment

banglapress24

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

১১১ শেলডন রোড # ১৮৮৪, ম্যানচেস্টার, কানেকটিকাট ০৬০৪২

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৫ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী