ছাবেদ সাথী
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুক্তরাজ্য কল্পকাহিনি, উপকথা ও কিংবদন্তির দেশ হিসেবে পরিচিত। তবে এই শহরে রাজনীতি ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি নতুন ‘কথিত কাহিনি’ আবারও চোখে পড়লো—যেটি সচেতনভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছে: যে ২০২৪ সালে কিয়ার স্টারমার ও লেবার পার্টি একটি বিপুল জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। বাস্তবতা হলো, বিষয়টি ঠিক তার উল্টো।
স্টারমারকে ঘিরে এলন মাস্কের ব্যক্তিগত বিরোধ থাকলেও, উভয় প্রান্তেই (যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে)—এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ অনেকে মনে করেন, স্টারমার ‘ভালো মানুষ’। কিন্তু তাঁর বিজয়ে “ভালোমানুষি”র তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।
২০২৪ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির ভোটব্যাংক প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। প্রকৃত পরিবর্তন এসেছিল কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি থেকে। যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী, বাস্তববাদী ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী ভোটাররা নিজেদের প্রতারিত ও অবহেলিত বোধ করেছিলেন—তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বাস্তবে কিছুই পাননি। তাই তারা ভোট দিতে যেতেই চাননি।
প্রথমবার ধোঁকা খেলে এক কথা, দ্বিতীয়বারে বিশ্বাস উঠে যায়, আর তৃতীয়বারে মানুষ সোজা সোজি বলে ওঠে: ‘আর নয়, আমি তোমার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছি।’
এই অভিজ্ঞতা কি ২০২৮ সালে রিপাবলিকান পার্টি ও আমেরিকান রক্ষণশীলদের জন্যও সত্য হতে পারে? এক নিমেষেই হতে পারে।
আমি যখন মার্কিন বামপন্থীদের বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের চিৎকার উপেক্ষা করি, তখনও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক শতাব্দীর এক নেতা। তবে অনেক বামপন্থী, একাডেমিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁর বিরুদ্ধে এতটা ক্ষুব্ধ শুধু এই কারণে যে, তাঁরা বিশ্বাস করেন ট্রাম্পই সেই বিরল ব্যক্তি যিনি তাঁদের তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ ও ‘ওয়োক’ নীতিগুলিকে মূল থেকে উৎখাত করার ক্ষমতা রাখেন—সরকার থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যন্ত সব জায়গায়।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ ভোটারের কাছে ট্রাম্পের প্রার্থিতা ছিল এক রকমের প্রার্থনার ফল। রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট, স্বাধীন চিন্তার মানুষ, এমনকি বহু উপেক্ষিত গোষ্ঠীর মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন—দুই দলের অভিজাত নেতৃত্ব তাঁদের পরিত্যাগ করেছে, এবং তাঁদের ভবিষ্যৎকে ত্যাজ্য উপাদানে রূপান্তর করেছে।
যুক্তরাজ্যের সেই বাস্তববাদী ভোটারদের মতো, আমেরিকানরাও সেই সময় নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের জুনে যখন ট্রাম্প সেই সোনালি এস্কেলেটরে নেমে এলেন, সব বদলে গেল।
২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে বিশ্ব রাজনীতিতে ভূমিকম্প সৃষ্টি করলেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বোঝা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের বহু দশকের পুরনো ‘ইউনিপার্টি’—অর্থ, ক্ষমতা, সুসম্পর্ক ও সুবিধাবাদী স্বার্থে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি—এই হুমকিকে সহ্য করবে না।
ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেই রাজনীতির অদৃশ্য প্রতিরোধের সম্মুখীন হন—সংসদ, প্রশাসন, আদালত ও এমনকি মূলধারার সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। অনেক সাংবাদিক নিজেদের ‘প্রতিরোধ’ দলের সদস্য বলে ঘোষণা করেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র মি. স্মিথ ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন-এ যে ‘টেইলর মেশিন’ দেখা যায়—যা মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করে—ঠিক সেইরকমই একটি ‘মেশিন’ ২০১৫ সাল থেকে ট্রাম্পের পেছনে লেগেছে। এবং এখন, এক দশক পর, তারা জানে সব কিছুই বাজিতে লেগে আছে। তাই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিটি দিক থেকে একনাগাড়ে আক্রমণ চলছেই।
এদিকে, লক্ষ লক্ষ আমেরিকান এখন ভাবতে শুরু করেছেন: ট্রাম্পের পাশে কে আছে? ২০১৬ সালের পর অনেকেই তাঁকে ছেড়ে গেছেন। এবারও কি ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে, একটু ভিন্ন কৌশলে?
এই আমেরিকানদের জন্য বিষয়টি খুবই সরল। ২০২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসনে যদি কেউ যোগ দেয়, তাহলে তাদের দায়িত্ব হলো প্রেসিডেন্টকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া। যদি না পারেন, তবে সেখানে থাকারই বা মানে কী?
উদাসীনতা, ভুল, ষড়যন্ত্র বা অহংকার—কোনোটিই বরদাশতযোগ্য নয়। এই কোটি কোটি মানুষ তাঁদের আশা, আস্থা ও বিশ্বাস ট্রাম্পের ওপর রেখেছেন। তিনি তাঁদের কাছে শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন—তিনি শেষ আশার প্রতীক।
যদি তারা অনুভব করে, ট্রাম্পকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বা বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে—তাহলে ২০২৮ সালে তারা ঘরে বসে থাকবেন। আর এতেই পুরো নির্বাচনের ফলাফল বদলে যেতে পারে।
তাদের কাছে এটি কেবল ‘টেইলর মেশিন’-এর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, এটি সেই শেষ সুযোগ—যার মাধ্যমে ট্রাম্প তাঁদের প্রিয় দেশকে আবার উদ্ধার করতে পারেন।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি পর্যবেক্ষক। সম্পাদক বাংলা প্রেস
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম