ছাবেদ সাথী
স্টিভ কলের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘অ্যাকিলিস ফাঁদে’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের পেছনের ইতিহাসকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। বইটিতে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে পারস্পরিক ভুলবোঝাবুঝি, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দলচিন্তাধারা এক বিপর্যয়কর যুদ্ধে রূপ নেয়। ঘরোয়া রাজনৈতিক চাহিদা ও মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বজায় রাখার অভিপ্রায়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা সাদ্দাম হোসেনের অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক বার্তাগুলোকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
একই সময়ে, চূড়ান্ত মূল্যায়ন দেওয়ার চাপে থাকা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রায়ই সবচেয়ে ভয়ংকর সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরেছিল, অথচ সাদ্দামের সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য বিষয়গুলো তারা আমলে নেয়নি।
ইরাক যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, কিভাবে ওয়াশিংটনের আদর্শবাদ, আমলাতান্ত্রিক গতি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিলে একটি বন্ধ তথ্যপ্রবাহের পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে ভীতি বাড়তে থাকে, কূটনীতিকে উপেক্ষা করা হয় এবং ভুল অনুমানই যুদ্ধের ন্যায্যতা হয়ে দাঁড়ায়। বইয়ের ‘অ্যাকিলিস ফাঁদে’ শিরোনামটি এমন এক পারস্পরিক ফাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে সাদ্দাম ও যুক্তরাষ্ট্র- উভয়ই ভুল সিদ্ধান্তের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং কেউই পথ পরিবর্তন করতে পারে না।
এই সতর্কতামূলক কাহিনি শুধু অতীতের ফিরে দেখা নয় -এটি আজকের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে, বিশেষ করে ইরান প্রসঙ্গে, একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
কলের মূল যুক্তি- যে ওয়াশিংটন প্রায়ই নিজস্ব ভুল বয়ানের বন্দি হয়ে পড়ে- তা ইরান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গত চার দশকের নীতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। ইরান সম্পর্কে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই সন্দেহনির্ভর, যেখানে বাস্তববাদী কূটনীতির চেয়ে সর্বোচ্চ দাবি বেশি গুরুত্ব পায়।
ইরানের জটিল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, স্তরবদ্ধ সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের যৌক্তিক পদক্ষেপগুলোকেও একমাত্র শত্রুভাবাপন্নতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সরলীকরণ এসেছে সেই একই কারণে, যেগুলো ইরাক যুদ্ধকে সম্ভব করেছিল-গোয়েন্দা তথ্যের অতিসরলীকরণ, লবিং চাপে নীতিনির্ধারণ এবং অতিরঞ্জিত আশঙ্কাকে পুরস্কৃত করা হয় এমন এক নিরাপত্তা সংস্কৃতি।
স্পষ্ট করে বলা দরকার, ইরান ইরাক নয়। তাদের ইতিহাস, শাসনব্যবস্থা ও কৌশলগত লক্ষ্য একেবারেই আলাদা। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি প্রণেতাদের একটি অংশ ইরানকে সেই একই মানসিকতা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছে, যেটি ইরাক যুদ্ধের সময় চালু ছিল।
গোয়েন্দা তথ্য এখানে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার ছাঁক দিয়ে ফিল্টার করা হয়। ইরানের প্রতিরোধমূলক অবস্থান এবং আঞ্চলিক কার্যকলাপকে কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে একমাত্র বৈরিতা হিসেবে দেখা হয়। এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হুমকির মূল্যায়নকে বিকৃত করেছে এবং কূটনীতিকে আটকে দিয়েছে।
এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বছরের পর বছর কঠোর পরিদর্শন চালিয়ে কোনো অস্ত্রায়ন প্রচেষ্টা পায়নি, তবু আমেরিকার রাজনৈতিক বক্তৃতায় এই কর্মসূচিকে একটি সামরিক হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের শান্তিপূর্ণ চরিত্র -শক্তি বৈচিত্র্য, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্বের দাবি- তা রাজনীতিকদের উৎকণ্ঠা ও লবিং নেটওয়ার্কের ছত্রছায়ায় হারিয়ে গেছে।
এই প্রকল্পের সূচনাও ছিল পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে খোলামেলা সহযোগিতায়। ১৯৭০-এর দশকে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে, এক গবেষণায় সুপারিশ করেছিল যে, ইরানকে ভবিষ্যতের জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য একটি বিস্তৃত বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি গড়ে তুলতে হবে। তখনও বিশাল তেলের মজুদ থাকা সত্ত্বেও, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বৈশ্বিক জ্বালানি প্রবণতা দেখে পরমাণু শক্তিকে একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আজ বিলুপ্তপ্রায়। তার পরিবর্তে, একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা এখন একটি অস্তিত্বগত সংকটে রূপ নিয়েছে -যেখানে ভুল ব্যাখ্যার চক্র কূটনীতি ধ্বংস করছে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলছে।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যর্থতা নয়-এটি একটি পদ্ধতিগত বিকৃতি।
ইরানকে ঘিরে এই বিকৃত তথ্যচিত্র কেবল দুর্বল বিশ্লেষণের ফসল নয়, বরং এটি একটি সচেতনভাবে নির্মিত রাজনৈতিক বয়ান, যার লক্ষ্য হলো সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করা। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার জানিয়েছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না-সর্বশেষ ২০২৫ সালের বার্ষিক হুমকি মূল্যায়নেও এই তথ্য পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে।
তারপরও, ভুল ধারণাগুলো টিকে আছে। কারণ, একটি গভীরভাবে প্রোথিত লবিং নেটওয়ার্ক এ থেকে উপকৃত হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কে রয়েছে -রক্ষণশীল আদর্শবাদী, প্রতিরক্ষা শিল্পের স্বার্থজড়িত গোষ্ঠী এবং ইসরায়েলপন্থী প্রভাবশালী গ্রুপ- যারা পরিকল্পিতভাবে ইরানকে চিরস্থায়ী শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করে।
এই গোষ্ঠী সংবাদমাধ্যমে প্রভাব রাখে, নীতিনির্ধারণে আধিপত্য করে এবং কূটনৈতিক সমাধান চাওয়া রাজনীতিকদের ওপর প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। এই কাঠামোর মুখোমুখি হওয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থায়ী চুক্তি অর্জন করতে হলে তাঁকে এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যূহ ভেদ করতে হবে। বিভ্রান্তিকর বয়ান ও সৃষ্ট আতঙ্কের মুখে দাঁড়িয়ে কূটনৈতিক বাস্তববাদকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এই কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নিছক প্রতীকী পদক্ষেপ নয় -এটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে পুনরুদ্ধার করার মৌলিক পদক্ষেপ, যাতে তা জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, ইরানের সঙ্গে সফল চুক্তি কেবল একটি কূটনৈতিক সাফল্য নয় -এটি প্রমাণ করবে যে ট্রাম্প ওয়াশিংটনের যুদ্ধ ও শান্তির নিয়ন্ত্রক অদৃশ্য যন্ত্রটিকে জয় করেছেন।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি পর্যবেক্ষক। সম্পাদক বাংলা প্রেস
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম