প্রায় দুমাস পর কবিতাহীন জীবন শেষে আবার ফিরে এলাম কিছু স্বচ্ছ আর কিছু অস্বচ্ছ ধারণা নিয়ে ইন্দ্রিয়ে এক ধরণের অপ্রাপ্তি তো রয়েছেই। দেশ থেকে ফিরে রক্তে বিশৃঙ্খল সুগারের মাত্রা বেড়ে আছে (প্রচুর খেয়েছি বলে), তাই প্রয়োজনীয় হৈচৈ ও এখন আর ভাল লাগেনা। কিছু দরকারি কথাতেই সব সারতে বেশি ভাল লাগে। নীতিকথা সবাই জানে, কিন্তু দেশে কেউ মানছে বলে আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি, আছে কিংবা নাই-এমন একটা শর্তেই যেন সবাই দিন পার করছে। ফসলের গায়েও এবার ঢেউ কম পেয়েছি, পরান মাঝির গলায় ভাটিয়ালী এবার তো শুনতেই পেলাম না। তারপরও জানালা তো আর ঘরের চাহিদা পূরণ করতে পারেনা। আবার অনেককেই দেখেছি সিজনে রিজন ছাড়াই রেইনকোর্ট পড়তে। জানিনা তার ভিতরেই বা কি ছিল। অনেক কবিকেও আবার দেখেছি হাটে বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ বিক্রি করতে। গেলবার যাঁদেরকে যুবতী রেখে এসেছিলাম এবার তাঁদেরকেও পৌড়া দেখলাম (লাইন অফ কন্ট্রোল তাঁরা মানছেন না বলেই মনে হল)। তবে একটা জিনিস এবার আমার খুব ভাল লেগেছে, তা হলো ফুল দিয়ে এখন শস্য কিনা যায়।
এবার দেশে গিয়েছিলাম ভাষার মাসে। তিনটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে এবার ১। নন্দনে নন্দিতা (কবিতার বই) ২। পরস্পরা (এটি জীবন ঘনিষ্ঠ ছোট ছোট প্রতিবেদনের নতুন সংযোজন, ৩। Each Other (পরস্পরা বইটির ইংরেজি অনুবাদ)। তিনটি গ্রন্থেই আমি আমার মনের মত স্বাধীন ভাবে শব্দের ব্যবহার করেছি, যাতে ব্যাপক আয়োজনও আছে। বেশ টলটলে আর নির্মোদ ভাবনার কারণে ব্যাতিক্রমী এই তিনটি বই-ই আপনাদের উপভোগ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস। নান্দনিক সুন্দরতা দিয়ে আমি আমার উর্বর চিন্তার সার্বিক ফসল ফলাবার চেষ্টা করেছি।
এবার দেশে মাত্র ২৮ দিন ছিলাম বলে একটা অতৃপ্তিকর প্রকরণগত সমস্যাও আমার হয়েছিল। অনেক বন্ধুদের কথা দিয়েও আমি কথা রাখতে পারিনি। অনেক রাত অবদি ঢাকার রাজপথে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। নেশার মারাত্মক ঘোরে অনেককেই মাথায় বিল্ডিং ঠেলতেও দেখেছি।শব্দের উৎপাতে বিকট দানবগুলোকে লাগামহীন গামা রেখা বরাবর ছুটতে দেখেছি। ট্রাক, বাস, অটো দিনে কিবা রাতে বাষ্পকে ঘূর্ণনের সময় পর্যন্ত তারা দেয়না। আসন্ন আহারের যে কি জ্বালা, খুব নিবিড় ভাবে আমি তাও দেখেছি। চাহিদার বিরহ খেলায় মানুষগুলো কিভাবে দোল খাচ্ছে এবেলা ওবেলা খুব কাছ থেকে আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি। প্ল্যাস্টিকের ছাউনিতে উদম প্রেমের উৎসব দেখেছি যেন রমণীর কোন লজ্জা নেই। কত শিশুকে ফসকে যেতে দেখলাম অভিবাবকের প্রসারিত হাত থেকে, অথচ পতনশীল সময়ে তাদেরকে স্থির রাখা খুব জরুরী ছিল। এই পথ শিশুরাই হাসি কলরব থেকে তারা বঞ্চিত।
শ্লোগানে শ্লোগানে ছেয়ে আছে দেয়াল, আমিও চাই শ্লোগান গুলো সত্য হোক, শ্লোগান মানেই আমার কাছে ঘটমান বর্তমানের সজাগকেই আমি বুঝি।দিনের বেলায় বরাদ্দকৃত কিছু জোড়া হাততালির ব্যবস্থাও দেখলাম, যদিও আমার স্থির বিশ্বাস অসঙ্গতি একদিন ভারমুক্ত হবেই।
কিলোমিটারে দেশে এখন দূরত্ব মাপা লঘু হয়েছে। এই আধুনিকতাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। আমি অনেককেই দেখেছি পথসাথী (এক সময় ফকির ছিল) থেকে মহাজন হয়েছে। নীতি বোধের কাছে অধৈর্য্য মানুষগুলো যেন কাঁপছে, কিছু লোককে দেখেছি বল্গাহীন ভাবে লুটেপুটে ভাগ করে নিচ্ছে। প্রকৃত প্রক্রিয়ায় যে তা হচ্ছেনা তা সহজেই অনুমেয়।
এতসব ভুলের মাঝেও অনেক উল্লাস দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি। ক্ষমাহীন অন্যায়ের পরেও কিছু মানুষের দম্ভ দেখে কেয়ামত পর্যন্ত তো আর চুপ করে থাকা যায়না। গণতান্ত্রিক উৎসব কিছুটা ব্যাহত হয়েছে, অন্তত বিরোধী ভাষাগুলো তাই প্রমাণ করে। খন্ড খন্ড বিচ্ছিন্ন নিরুপায় নিরবতা আমি তাও দেখেছি। অনেককে চোরের মত সংকোচিত জীবন যাপন করতেও দেখেছি। এত কিছুর পরেও না বোঝা মানুষগুলো ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় এখনও আস্থা রাখছে।
অনেক বন্ধু দেশে যাবার আগে আমাকে তাঁদের ঠিকানা দিয়েছিলেন। মূলত দেশে গিয়ে সেগুলো বাতাসের ঠিকানা বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। যে কথা বলছিলাম, আমাদের প্রাণের সাহিত্য, তাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করার জন্য আরো বেশি মনোনিবেশ প্রয়োজন আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য অনুবাদ বিশ্বের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের জায়গা করে নিতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে চাহিদা আরো বাড়াতে হবে। এই প্রসঙ্গে প্রতীক্ষা এবং প্রত্যাশা দুটোই আমি রেখে গেলাম।
একুশে এবার আগুনে ফাগুন না থাকলেও অনেক নবীন কবিদের উৎসবে ট্যারমাক উদ্দাম আমি লক্ষ্য করেছি। অনেকের মেধার দ্যুতিতে আমি মোহিত হয়েছি। এমন প্রত্যয়ে আমি বরাবর নিঃশঙ্ক দৃঢ়ই থাকতে চাই। এবারে ফেব্রুয়ারি মাসে শীতের ফিনফিনে হাওয়া ছিলনা ফলে এক ধরণের অসহ্য তাড়নার দহন থেকে বিপন্ন ভাবেই প্রচুর ঘুরে বেড়িয়েছি।
এই মহাবিশ্বে আমি বাংলা ভাষার অমরত্ব চাই বলেই জমানো করতালিতে আমি মেধা যাচাই করতে চাইনা। সবুজের প্রতি পক্ষপাত আমার সাড়া জীবনের। তাই আমি সেখানেই মুক্তির স্বাদ পাই। জাতীয় কিছু ইগো ও অভিমান আমাদেরকে বর্ধিত আয়ুষ্কাল দেবেনা ফলে মধ্যবর্তী কোন কিছুতেই আমার আস্থা নেই।
খেতাব আর প্রতাপের ব্যবধান আমি ভালোই বুঝি। তারপরেও খানাখন্দের হাজার প্রতিশ্রতি আমাকে বিব্রত করেছে। ব্যাংকে ভেজাল, র্যাঙ্কে ভেজাল, বুদ্ধিতে ভেজাল, খাদ্যে ভেজাল, লাজে ভেজাল, লজ্জায় ভেজাল, কোথায় ভেজাল নেই বলুন? এমনকি ক্রমিক সংখ্যায় ও অনেকের সততায় ভেজাল আছে। কানুনের মারপ্যাঁচে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে খাওয়াটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমাদের। তবে আশার কথা প্রতিনিয়তই ভেজাল বিরোধী অভিযান চলছে তাই পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা এখনো বাজেনি বলেই শূন্যস্থান আমাদেরকে এখনই পূরণ করতে হবে।
দল আর দলাদলি একটি দেশকে খুব বেশি কিছু দিতে পারে বলে আমার মনে হয়না। তবে দুই পক্ষই যে গুটি নাড়ছে তা সহজেই বুঝা যায়। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চর্চা আমাকে বেশ উৎফুল্ল করেছে মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তিই তো ছিল সেটি। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে একদিন উন্নত দেশে পরিণত হব। মধ্য আয়ুর দেশ হব। এমন গন্তব্যে যাবার উল্লাস ইদানীং আমার খুব কাজ করে। আশার কথা আমাদের জিডিপির মাত্রা, দৃশ্যমান পদ্মাসেতু, পাতাল রেল, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, উড়াল পথ, প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি এসবই গুড গভর্নেসের লক্ষণ। তারপরেও বলি একেকজন বন্দির জন্য ৪ থেকে ৬ স্কয়ার ইয়ার্ড জায়গা আমার কাছে অমানবিক এবং অপ্রতুল বলেই মনে হয়েছে (জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কিংবা জামিনে আসা হাজতিদের বয়ান থেকেই আমি তা জেনেছি)। ব্যক্তি হিসাবে আমি কিংবা আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কিছু আছে বলেই এত এবার দেশে থেকে ফিরে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু লিখলাম।
সবশেষে বাসাপের কর্ণধার মোঃ ওমর ফারুকের কাছে আমি ঋণী এবং তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে আমার তিনটি বই ছাপিয়েছেন। বিপণন ব্যবস্থা আরো আধুনিকায়ন হলে বই গুলো আরো জনপ্রিয়তা পেত বলেই আমার বিশ্বাস। নিজের বই বলেই বলছিনা। বইগুলো আসলেই সংগ্রহে রাখার মত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে যারাই আমাকে উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়েছেন আমি পৃথক পৃথক ভাবে সেই সকল বন্ধুদের নাম উল্লেখ করতে চাইনা। আমি আমার প্রাণের প্রিয় সেই সকল বন্ধুদের কাছে ঋণী এবং কৃতজ্ঞ।
২০১৯ সালের বই মেলায় আমার প্রকাশিত তিনটি বই-
১। নন্দনে নন্দিতা
২। পরস্পরা
৩। Each Other (পরস্পরা বইটির ইংরেজি অনুবাদ)
বিশ্বের সকল বইপ্রেমীদের বইগুলো পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের হাডসন (নিউ ইয়র্ক) প্রবাসী কবি ও লেখক