Home Uncategorized এমন পুরুষকে শাস্তি দিতে পারে নারীই

এমন পুরুষকে শাস্তি দিতে পারে নারীই

by bnbanglapress
A+A-
Reset

তুরাগ পরিবহনে এক ছাত্রীর যৌন হয়রানির চেষ্টা ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানিয়ে সহপাঠীরা গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। ছবি: হাসান রাজা

গল্পটা গণপরিবহনে যাতায়াত করা এক নারীর। এই নারী কর্মজীবী। বেতন খুব বেশি নয়। তার ওপর পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তাই নিজের জন্য খুব বেশি খরচের সুযোগ নেই। চাইলেই রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা উবারে যাতায়াত করতে পারেন না।

মেয়েটির বাড়ি পুরান ঢাকায়। কর্মস্থল ধানমন্ডি। প্রতিদিনই গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয় তাঁকে। আমরা যেটিকে মুখে মুখে বলি লোকাল বাস। প্রথম দিকে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি ফিরে মেয়েটি কাঁদতেন। কোনো দিন হয়তো বাসের ভিড়ে যৌন হয়রানির শিকার হতে হতো। কোনো দিন আবার বাস থেকে নামার সময় সুপারভাইজার অযাচিত সাহায্য করতে চাইতেন। সুযোগ বুঝে যৌন হয়রানি করতেন। আবার কোনো দিন এসবের কোনোটাই হতো না। কিন্তু যেসব শুনতে হতো তাতে মনটা বিষিয়ে থাকত। নারীর জন্য নির্ধারিত আসনে বসা নিয়ে সহযাত্রী পুরুষেরা গলার রগ ফাটিয়ে কটু কথা শোনাতেন। বলতেন সমান অধিকার চাইবেন, আবার নারীর জন্য নির্ধারিত আসনেও বসবেন। মেয়েটি প্রথম প্রথম দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যেতেন।

ধীরে ধীরে মেয়েটি প্রতিবাদী হন। সুপারভাইজার বাসে ওঠার সময় হয়রানি করতে চাইলে চড়া গলায় বলেন, ‘আপনাকে বলেছি সাহায্য করতে? মেয়েদের গায়ে হাত দিতে খুব ভালো লাগে, না?’ সুপারভাইজার দমে যান।

মেয়েটি তাঁর হাতের নখ বড় রাখেন। ব্যাগে সেফটিপিনও বাদ যায় না। ভিড়ের মধ্যে কেউ যৌন হয়রানি করার চেষ্টা করলে নখ বা সেফটিপিন দিয়ে আঘাত করেন তাঁকে। পুরুষটি যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলে বলেন, হলো কী ভাই? ব্যথা পেলেন?

নারী আসনে বসা নিয়ে কেউ টিটকিরি করলে ঝাঁজিয়ে ওঠেন মেয়েটি। বলেন, ‘পুরুষদের চরিত্রের জন্যই তো আমাদের আলাদা আসনে বসতে হয়।’ মেয়েটি ধীরে ধীরে শিখে যান ভিড়ের মধ্যে লোকাল বাসের ঠিক কোনখানটায় দাঁড়ালে কেউ হয়রানি করার সুযোগ কম পাবে। কাঁধের ব্যাগটাকে কীভাবে নিজের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

এই মেয়ের গল্পটা কিন্তু একা তাঁর নয়। গণপরিবহন, যদি সত্যিই এটাকে গণপরিবহন বলা যায়, সেখানে চলাচল করা তাঁর মতো আরও অনেক মেয়ের গল্প প্রায় একই রকম। তাঁরা এভাবেই নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। দুই বাসের মাঝখানে পড়ে ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের হাত কাটা পড়ে। জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। গণপরিবহনে এসব যৌন হয়রানির মুখে এই নারীদের জীবনও প্রতিনিয়ত চিড়েচ্যাপ্টা হয়। স্বপ্নগুলো মরে যায়।

কখনো পরিস্থিতি চরমে ওঠে। দুপেয়ে জন্তু যাদের আরেক নাম ধর্ষক, তারা শেষ করে দেয় জীবনটাকে। চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার ভারতের নির্ভয়ার জীবন যেমন নিভে গেছে। সাভারে চলন্ত বাসে পোশাকশ্রমিকদের ধর্ষণের খবর যেমন প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতায় আসে; যেমন ঘটতে চলেছিল তুরাগ বাসে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীর সঙ্গে। যেমন শেষ হয়ে গিয়েছিল চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার টাঙ্গাইলের রূপার স্বপ্ন, রূপার জীবন। এ রকম আরও অনেক রূপা আছে। তাঁদের কথা হয়তো গণমাধ্যম আসেনি।

প্রশ্ন জাগে, এই পুরুষেরা আসলে কারা? গণপরিবহন উঠলেই কেন তাঁরা বর্বর হয়ে ওঠেন? এই পুরুষই তো বিলাসবহুল বাসে নিরাপদ দূরত্বে বসেন। যাতায়াতের পথে সসম্মানে নারীকে জায়গা ছেড়ে দেন। গণপরিবহনের এই চালকই তো উবারচালক হলে সসম্মানে নারীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। আন্তনগর ট্রেন বা উড়োজাহাজের যাত্রী এই পুরুষই তো দিব্যি ভদ্রলোক। তবে কি কেবল সাধারণ বাসে চড়া পুরুষেরাই যৌন নিপীড়ক? সবটাই কি কেবল নিম্নবিত্ত পুরুষেরাই করেন? তাই বা বলি কী করে?

মি টুর বদৌলতে সমাজের উঁচুতলার পুরুষদের যৌন হয়রানির কথা আমাদের জানা। তাহলে ধরে নিতে হয় পুরুষ সুযোগসন্ধানী। ভিড়ের মধ্যে অপরিচিত নারীকে যৌন হয়রানি করার সুযোগ তাঁরা ছাড়তে চান না? আবার এটাও সত্যি, সব পুরুষই তো এমন নন। রূপার ধর্ষণ আর হত্যার বিচার চেয়ে এই পুরুষই তো নেমেছেন রাস্তায়। উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হয়রানির প্রতিবাদে তাঁর পুরুষ সহপাঠীরা তো নেমেছেন রাস্তায়। তুরাগ বাস আটকে অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। হয়তো বেশির ভাগ পুরুষই ভালো। একশ্রেণির লোলুপ ধর্ষকদের জন্যই পুরুষের যত বদনাম।

কারণটা যা-ই হোক, এত কিছু ভাবার সময় এখন আর নারীর নেই। প্রতিবাদী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আওয়াজ তুলতে হবেই। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে নারীকেই। ‘আমাকে বাঁচান’ বলে চিৎকার করার বদলে নিজে বাঁচতে শিখতে হবে। শুরুটা হতে পারে ছোট ছোট প্রতিবাদ দিয়েই।

আত্মরক্ষার জন্য শারীরিক আঘাত করার সামর্থ্য থাকাটাও জরুরি। মেয়েশিশুকে এখন নাচ শেখানোর চেয়ে বেশি জরুরি কারাতে বা তায়কোয়ান্দো শেখানো। নারীদের জন্য পারলারে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি কারাতের মারপ্যাঁচ শেখা। ভিড়ের বাসে যৌন হয়রানিকারী পুরুষকে কারাতের দুই ঘায়ে ঘায়েল করা গেলে মন্দ কী? ঘাড়ের ব্যাগটা দিয়ে শরীর আড়াল না করে নিপীড়ক পুরুষের ঘাড়ে মেরে দিন না দু-ঘা। প্রতিবাদী হোন। যাঁর যা পাওনা শাস্তি তা তাঁকে দিন। খুলে দিন হয়রানিকারী পুরুষের মুখোশ।

আমাদের দেশে নারীরা খুব বেশি ‘ভালো মেয়ে’ হতে চান। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক সময় নিপীড়ন চুপ করে সহ্য করেন। আশা করেন, কোনো পুরুষ এসে তাঁকে বাঁচাবেন। চেষ্টা করুন না নিজেই নিজেকে বাঁচানোর। কাজটা খুব কঠিন নয় কিন্তু। গণপরিবহনে যৌন নিপীড়ক পুরুষ কিন্তু দুর্বল। ভীরু। সে ভয়ে ভয়েই লুকিয়ে ভিড়ের মধ্যে যৌন হয়রানির সুযোগ খোঁজে। আপনার সাহসী প্রতিবাদের মুখে সে পরাজিত হতে বাধ্য।

আশার কথা, নারী জাগছে। মেয়েশিশুকে অনেকেই এখন কারাতে শেখাতে আগ্রহী। অনেক নারীই ফেসবুকে নিজেদের হয়রানির কথা প্রকাশ্যে বলছেন। রাস্তাঘাটেও প্রতিবাদী নারী বাড়ছে। ৯৯৯-এ ফোন করে যৌন নিপীড়ককে শাস্তিও দিচ্ছেন অনেকে।

এসব করে সব সময় হয় তো বাঁচা যায় না। যৌন হয়রানির মাত্রা চরম হলে দায়িত্ব নিতে হয় রাষ্ট্র ও সরকারকে। করতে হয় ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার না পেলেও নারী করতে পারেন প্রতিবাদ।

নারীর প্রতিবাদ ও সচেতনতার জায়গা আরও আছে। যৌন নিপীড়ক পুরুষ তো কোনো না কোনো পরিবারেরই সদস্য। সেই পরিবারের নারীরাও অনেক সময় তাঁদের প্রশ্রয় দিয়ে যান। অনেক পরিবারেই দেখা যায়, স্বামী গৃহকর্মীকে যৌন নিপীড়ন করছেন। স্ত্রী স্বামীকে নয়, দোষারোপ করছেন ওই গৃহকর্মীকে। উত্ত্যক্তকারী ছেলের মা ছেলেকে শাসন না করে দোষ দিচ্ছেন প্রতিবেশী মেয়েটির চালচলনকে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারীর মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি।

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’। ছেলেবেলায় পড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা আবার ঝালিয়ে নিন। অন্যায়কারীকে শাস্তি দিন। পুরুষকে জানিয়ে দিন, আপনি নারী। কোনো নারীর অসম্মান আপনি বরদাশত করবেন না। পরিবারে এমন পুরুষ থাকলে তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা করুন। না পারলে শাস্তি দিন। নারীশক্তি বিকশিত করুন। নিজেকে সম্মান দিতে শিখুন। সম্মান আদায় করে নিতে শিখুন। পুরুষের ওপর নির্ভরতা কমান।

জয় হোক নারীর। জয় হোক পুরুষের। জয় হোক মানবতার।

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী