কারও সঙ্গে কথা বলছেন না রাসেল সরকার। বিহ্বল দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকছেন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে তাঁকে ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। চিকিৎসকেরা রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করায় আত্মীয়স্বজনও চুপচাপ তাঁকে দেখে চলে আসছেন।
দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। পা হারিয়েছেন রাসেল। গতকাল শনিবার দুর্ঘটনার পর পর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রথমে স্কয়ার হাসপাতাল, পরে অ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গতকাল যাত্রাবাড়ীতে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস রাসেলের পায়ের ওপর তুলে দিলে তাঁর পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর থেকে রাসেলের পরিবার ও কর্মক্ষেত্র থেকে বারবার গ্রিন লাইন পরিবহনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
রাসেলের ভাই আরিফ সরকার আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বাস আমার ভাইয়ের এত বড় ক্ষতি করল, সেই বাসের কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের খবরও নিতে আসেনি। ভাই কি মরেছে না বেঁচে আছে, সে কথাও তাদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। সারাটা জীবন যে তাঁকে পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে, সে কথাও কি তারা একবারও ভেবেছে?’
ক্ষুব্ধ স্বরে তিনি বলেন, ‘আটকের পর গ্রিন লাইন বাসের চালকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল গতকাল। তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি আমার ভাইয়ের পায়ের ওপর বাস চালিয়ে দিলেন? চালক কবির মিয়া কোনো উত্তর দেননি। একটা লাইফ শেষ করে দিলেন! কেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর দেননি কবির।’
রাসেলের শারীরিক অবস্থা জানাতে গিয়ে আরিফ সরকার বলেন, রাসেলের অবস্থা বেশি ভালো না। গতকাল রাতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে তাঁর অপারেশন করা হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে তাঁকে। অপারেশনের পর আইসিইউতে ছিলেন। পরে তাঁকে ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, রাসেল কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকছেন। মুখে কিছু না বললেও দেখলে বোঝা যায় যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে রাসেল দ্বিতীয়। পরিবার নিয়ে রাসেল সরকার মোহাম্মদপুরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় থাকেন। সেখানে থাকেন তাঁর স্ত্রী মীম আক্তার আর ১৭ মাস বয়সী ছেলে। এখন এই পরিবার শুধুই অন্ধকার দেখছে।
রাসেল যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সেই প্রতিষ্ঠান পিআর এনার্জির ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাসেলের চিকিৎসা খরচ দিচ্ছি। কিন্তু রাসেলের সারা জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, তার জন্য বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে গ্রিন লাইন বাস কর্তৃপক্ষকে। এখন পর্যন্ত গ্রিন লাইনের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এ বিষয়ে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।’
আহত রাসেল সরকার (২৩) একটি রেন্ট-এ-কার প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালাতেন। একটি কোম্পানি রাসেল সরকারের গাড়ি ভাড়া করেছিল। গতকাল বিকেলে ওই কাজ শেষ করে কেরানীগঞ্জ থেকে তিনি ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে যাত্রাবাড়ীতে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাস তাঁর গাড়িকে ধাক্কা দেয়। পরে গাড়ি থামিয়ে বাসের সামনে গিয়ে বাসচালককে নামতে বলেন রাসেল। শুরু হয়ে যায় বাসের চালক ও রাসেলের মধ্যে কথা-কাটাকাটি। এ সময় গ্রিন লাইন পরিবহনের চালক বাস চালানো শুরু করেন। তখন রাসেল সরতে গেলে ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে আটকে পড়েন। তাঁর পায়ের ওপর দিয়েই বাস চলে যায়। এতে তাঁর বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পথচারীরা রাসেলকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বাস ও চালক কবির মিয়াকে আটক করে শাহবাগ থানার পুলিশ।
বাসের চাপায় রাসেল সরকারের পা হারানোর ঘটনায় রাজধানী ঢাকায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় গ্রিন লাইন বাসের চালক কবির মিয়াকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাসেল সরকারের বড় ভাই মো. আরিফ সরকার মামলাটি করেন।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলায় কবির মিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল রাতেই তাঁকে শাহবাগ থানা থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে আসা হয়। তাঁকে আজকেই আদালতে চালান দেওয়া হবে এবং আমরা পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করব।’