জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে ছয়জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একজনকে শাস্তি হিসেবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দুজনকে দেওয়া হয়েছে লঘু শাস্তি। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আর একজনের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে করা আবেদনপত্রই গায়েব হয়ে গেছে।
চাকরিচ্যুত হওয়া শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লঘু শাস্তি পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে একজন নিরপেক্ষ; বাকিরা উপাচার্যপন্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
সর্বশেষ বিভাগের দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল হালিম প্রামাণিককে তিরস্কার ও তাঁর পদোন্নতি দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ভুক্তভোগী ছাত্রীরা দাবি করেছেন, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী এটা তেমন কোনো শাস্তি নয়, বরং তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নতুন করে ঘটনার তদন্ত ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের মে মাসে মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন তাঁর বিভাগের এক ছাত্রী। পরে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কমিটি বলেছে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
এই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমানও একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।
একই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন ও মানসিকভাবে হয়রানির অভিযোগ ওঠে বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লা আল-মমিনের বিরুদ্ধে। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ চূড়ান্ত তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ দুই বছরের জন্য তাঁর পদোন্নতি স্থগিত করে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন তাঁর এক ছাত্রী। এ অভিযোগের পর তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দেয় প্রশাসন। পরে তদন্ত কমিটি এক মাসের মধ্যে ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় এবং সাখাওয়াত হোসেনকে দোষী সাব্যস্ত করে। শাস্তি হিসেবে তাঁকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপকে পদাবনতি করা হয়েছিল এবং পরবর্তী পাঁচ বছর পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছিল। তিনি উপাচার্যপন্থী বা বিরোধী কোনো পক্ষেই ছিলেন না।
২০১৬ সালের এপ্রিলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব ও একাধিক শিক্ষার্থীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোশারেফ হোসেন ওরফে রাজীব মীরের বিরুদ্ধে। পৃথক তিনটি কমিটি এ ঘটনার তদন্ত করে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৪তম সিন্ডিকেট সভায় তাঁকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি উপাচার্যবিরোধী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাট্যকলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হালিম প্রামাণিকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন তাঁর বিভাগের এক ছাত্রী। ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এই দিনই দুপুরে এ ঘটনায় জরুরি ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। পরে ওই শিক্ষককে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই দিন বিকেলেই এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরেকটি যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন একই বিভাগের আরেক ছাত্রী। দুটি তদন্ত শেষে আবদুল হালিম প্রামাণিককে তিরস্কার করা হয় এবং পদোন্নতি দুই বছর স্থগিত করা হয়।
গতকাল শনিবার ওই দুই ছাত্রী প্রথম আলোকে জানান, পরে যে অভিযোগটি দেওয়া হয়েছে, সেটি আরও এক বছর আগের ঘটনা। আবদুল হালিম প্রামাণিকের ভয়ে তিনি প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে সাহস পাননি। তাই প্রথম অভিযোগটি জমা দেওয়ার পর দ্বিতীয়টি জমা দেওয়া হয়। পরে এ দুটি ঘটনা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল’ তদন্ত করে এবং এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু অজানা কারণে ফের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ কমিটির প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান। এই কমিটি দু্ই ছাত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে অভিযুক্ত শিক্ষককে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে তাঁরা সায় দেননি। বরং তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপাচার্য মীজানুর রহমানকে জানান। তখন উপাচার্য এ কমিটি বাতিল করে আরেকটি কমিটি করার আশ্বাস দেন তাঁদের। কিন্তু সেটি আর করা হয়নি। তারপর এই লঘু শাস্তি দেওয়া হলো।
গতকাল ওই দুই ছাত্রী বলেন, দ্বিতীয় কমিটির প্রতি অনাস্থা দেওয়ার পরও তাদের প্রতিবেদন গ্রহণ করেছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন আচরণ করলে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বাড়বে। তাঁরা তাঁদের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত কমিটির প্রধান মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করা খুবই কঠিন। তারপরও ছাত্রীদের কথা শুনে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমরা বুঝতে পারছি, এটা যৌন হয়রানির প্রাথমিক ধাপ ছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা এমনটাই বলেছি। তবে আগের কমিটির প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে যৌন হয়রানিই বলা হয়েছিল।’
সবশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে উপাচার্যপন্থী হিসেবে পরিচিত বাংলা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ করেছিলেন এই বিভাগের এক ছাত্রী। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে অভিযোগের আর কোনো তদন্ত হয়নি। অভিযোগের চিঠিই নাকি এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তবে তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনপন্থী হলে অপরাধ করে কিছুটা হলেও ছাড় পাওয়া যায়। অন্তত এমন নজির সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়।
গতকাল রাতে এসব বিষয় নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা হয়। তবে তিনি গ্রামের
বাড়িতে থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বিস্তারিত কথা বলা সম্ভব হয়নি। নাট্যকলা বিভাগের দুই ছাত্রীর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এই দুই ছাত্রীর বিচারপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তা একটি প্রতিবেদন আকারে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।