Home Uncategorized রামপালসহ সব কারখানা পুরোদমে চালুর আগেই সুন্দরবনের ক্ষতি শুরু

রামপালসহ সব কারখানা পুরোদমে চালুর আগেই সুন্দরবনের ক্ষতি শুরু

by bnbanglapress
A+A-
Reset
  • সুন্দরবনের প্রতিবেশ নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণা।
  • চারপাশের কলকারখানার দূষণে সুন্দরবনের ক্ষতি শুরু।
  • সুন্দরবনের পাশে ১০ কিমির মধ্যে শিল্পকারখানা ১৯০ টি।
  • মারাত্মকভাবে দূষণকারী শিল্পকারখানা ২৪ টি
  • কারখানার পার্শ্ববর্তী নদীতে প্রতি ঘণ্টায় ৭-৮টি ডলফিন দেখা গেছে।
  • কারখানা নেই এমন স্থানে ডলফিন দেখা গেছে ১৫-১৭ টি।
  • নতুন সমীক্ষায় কারখানার পাশে সুন্দরবন এলাকায় বাঘের বিচরণ কমছে।
  • সুন্দরীগাছের বীজ নষ্ট হচ্ছে ৭০ %।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের চারপাশের সব কারখানা পুরোদমে চালু হওয়ার আগেই সুন্দরবনের ক্ষতি শুরু হয়েছে। বনের শুধু উদ্ভিদ ও প্রাণীই ধ্বংস হচ্ছে না, কারখানার আশপাশের এলাকার খাদ্যচক্রও ভেঙে পড়ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই শ্বাসমূলীয় বনের চারপাশে ২০০ টির মতো কারখানা নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতির এই চিত্র পাওয়া গেছে। সব কারখানা নির্মাণ শেষে পুরোদমে চালু হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষকের সমীক্ষায় এই চিত্র উঠে এসেছে। ‘সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপরে শিল্পকারখানা ও অবকাঠামোর প্রভাব’ শীর্ষক সমীক্ষাটি চলতি সপ্তাহে চূড়ান্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই বছর ধরে চলা সমীক্ষার কাজটি গত বছরের জুনে শেষ হয়।

সমীক্ষাটি করা হয়েছে সুন্দরবন-সংলগ্ন মোংলা ও রামপাল এলাকায়। বনের পাশে শিল্পকারখানা আছে এবং নেই—এমন দুই ধরনের এলাকা সমীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়। সুন্দরবনের ২৫ ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী কী অবস্থায় রয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কারখানা আছে এমন এলাকায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা, কারখানা নেই এমন এলাকার চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কম। বিশেষ করে, সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরীর শ্বাসমূলে শিল্পবর্জ্য জমে থাকতে দেখা গেছে। এতে বৃক্ষের জন্য অক্সিজেন সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারখানা আছে এমন এলাকার পাশে জোয়ার-ভাটায় আসা সুন্দরীগাছের বীজের ৭০ শতাংশই মারা যাচ্ছে। ফলে ওই সব এলাকায় নতুন করে আর সুন্দরীগাছ জন্মাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন নিয়ে সমীক্ষা করছি। এই সমীক্ষা তারই অংশ। সুন্দরবনের চারপাশে গড়ে ওঠা কারখানার কারণেই এসব ক্ষতি শুরু হয়েছে। এখনই এর লাগাম না টানলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়তে পারে। সুন্দরবন রক্ষা করতে চাইলে সরকারের উচিত এখনই কারখানাগুলো এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া।’

সুন্দরবনের ছয়টি জায়গা ডলফিনের জন্য অভয়ারণ্য ঘোষিত। এর মধ্যে দুটি পশুর নদে। ডলফিনের বাসা হিসেবে খ্যাত ওই এলাকার পাশে ২০০ টির মতো শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। ওই সমীক্ষায় কারখানার পার্শ্ববর্তী নদীতে প্রতি ঘণ্টায় সাত-আটটি ডলফিন দেখা গেছে। আর কারখানা নেই এমন স্থানে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ১৭।

২০১৫ সালে বন বিভাগের জরিপে পৃথিবীজুড়ে মহাবিপন্ন সুন্দরবনের বাঘ বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০৫। আর ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় কারখানার পার্শ্ববর্তী সুন্দরবন এলাকায় বাঘের বিচরণ কমে যেতে দেখা গেছে। কারখানা আছে বনের এমন পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিন থেকে চারটি বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। কারখানা নেই এমন স্থানে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে ১১ থেকে ১৫ টি। কারখানার কারণে ওই এলাকা থেকে বাঘ অন্যত্র সরে যাচ্ছে বলে গবেষকেরা মনে করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের চারপাশে কোনো কারখানার অনুমতি দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু কারখানাগুলো পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে। এটি ভিন্ন একটি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’

১৯৯৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে এমন এলাকাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করে প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়, ওই এলাকার প্রকৃতি, পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। এরই মধ্যে ২০১০ সালে সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। ২০১১ সাল থেকেই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে ২০০ টির মতো শিল্পকারখানা করার উদ্যোগ নেন, জমি কিনে তা ভরাট করেন। অনেক কারখানায় উৎপাদনও শুরু হয়েছে।

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মধ্যে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জমি কিনে তা ভরাট করছেন। তাঁদের বেশির ভাগকেই পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। এর সব কটিই দূষণকারী। আর এগুলোর মধ্যে ২৪টি মারাত্মকভাবে দূষণকারী।

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) গত বছরের জুনে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবনের চারপাশে শিল্পকারখানা স্থাপনে আপত্তি তোলে। তারা সরকারকে এই অঞ্চলের ওপর একটা কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) করতে বলেছে। এর আগে সেখানে শিল্পকারখানার অনুমোদন না দিতে সরকারকে অনুরোধ করেছে ইউনেসকো।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসইএ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই অঞ্চলে নতুন কোনো শিল্পকারখানার অনুমোদন দিচ্ছি না। পুরোনোদের নবায়ন করছি না। উচ্চ আদালত থেকে পরবর্তী নির্দেশ পেলে এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

দূষণের কবলে মাটি-পানি-বাতাস
সমীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণার সংখ্যা সুন্দরবনের পাশের শিল্পকারখানা এলাকায় অনেক বেশি, প্রতি লিটারে ৬৭৮ মাইক্রোগ্রাম। আর কারখানা নেই এমন এলাকায় তা প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম।

ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণা বেড়ে গেলে পানির নিচে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছায় না, এতে জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক উদ্ভিদকণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদ্ভিদকণা হলো প্রাণিকণার প্রাথমিক খাদ্য। উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা আবার মাছের খাবার। মাছ বড় প্রাণীর খাবার। এভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা থেকে শুরু করে বাঘ পর্যন্ত সুন্দরবনের খাদ্যচক্র গড়ে উঠেছে। উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা কমে গেলে ধাপে ধাপে বাঘ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সমীক্ষায় সুন্দরবনের পাশে কারখানা আছে এমন এলাকার বনে উদ্ভিদকণা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৩০ প্রজাতির। আর শিল্পকারখানা নেই এমন এলাকায় তা ৫১ প্রজাতির। এই দুই ধরনের এলাকায় যথাক্রমে ২০ ও ২৯ প্রজাতির প্রাণিকণা পাওয়া গেছে। জলজ পরিবেশের খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ায় ব্যাঙের রেণুর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।

শিল্পকারখানার এলাকায় মাটি দূষিত হয়ে পড়ছে। কারখানা রয়েছে এমন এলাকার প্রতি কেজি মাটিতে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৬ মাইক্রোগ্রাম তেল পাওয়া গেছে। আর শিল্পকারখানা নেই এমন এলাকায় এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬ মাইক্রোগ্রাম। শিল্পকারখানা এলাকায় বাতাসও দূষিত। সেখানে বাতাসে সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি।

সুন্দরবনের পশু, পাখি, গাছ, বাঘ, বন্য শূকর, মাছসহ ২৫ প্রজাতির জলজ ও উদ্ভিদের সংখ্যা শিল্পকারখানা এলাকায় কম বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এসব প্রজাতি মিলেই বনের জীববৈচিত্র্য। এসব প্রজাতি হুমকির মুখে পড়লে গোটা বনে এর প্রভাব পড়বে।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার এত দিন বলত, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্পকারখানার কারণে সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়ে আমাদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য নেই। এর আগে আমরা ১৩টি গবেষণা প্রতিবেদন দিয়েছি। সরকার এগুলোর কোনো জবাব দেয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণায়ও সুন্দরবনের ভয়াবহ ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে।’ এখনো যদি সরকারের টনক না নড়ে, তাহলে সুন্দরবন ধ্বংস হলে কি তাদের ঘুম ভাঙবে-সেই প্রশ্ন করে সুলতানা কামাল বলেন, সুন্দরবন বাঁচাতে হলে অবিলম্বে এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী