Home Uncategorized চর বাঁচাতে অনন্য উদ্যোগ

চর বাঁচাতে অনন্য উদ্যোগ

by bnbanglapress
A+A-
Reset

নানা ধরনের সামাজিক কাজে স্বেচ্ছাশ্রমের চর্চা গ্রামবাংলার একটা সহজাত আচরণ। এসব আচরণের সর্বসাম্প্রতিক অনুশীলন ছিল যশোরের মনিরামপুরের ভাসমান সেতু আর রাঙামাটির বাঘাইছড়ির কাচলং নদীর বারিবিন্দু ঘাটে কাঠের সেতু তৈরি। দুই ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ নিরুপায় হয়ে তাঁদের কিছুটা জানা, কিছুটা শেখা, কিছুটা ধারণা আর আঁচ-অনুমানের প্রযুক্তি দিয়ে সাহসের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করেছেন।

এ রকম আরও এক উদাহরণ তৈরি হলো। ব্রহ্মপুত্রের গহিন চরের কিছু সাহসী নারী-পুরুষ দেশীয় প্রযুক্তি আর বুদ্ধি খাটিয়ে ভাঙনের মোকাবিলায় এককাট্টা হয়েছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে শহরের একদল তরুণ, বন্ধুসভা আর প্রথম আলো।

ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম পারের অনেক জেলার এক জেলা গাইবান্ধার কামারজানি ইউনিয়নের চরগ্রাম কুন্দেরপাড়া। কুন্দেরপাড়া ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ক্রমেই জেগে উঠতে থাকে। ধু ধু বালুর চর। নদীভাঙনের শিকার সব হারানো মানুষ এক এক করে এ চরে ভাঙা চাল আর পুরোনো খুঁটি নিয়ে বসতি গড়ার চেষ্টা করতে থাকেন। একেবারেই তলানিতে চলে যাওয়া নিরুপায় মানুষের শেষ উপায় ছিল কুন্দেরপাড়া।

সাড়ে তিন বর্গ কিলোমিটারের এই চরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শ খানেক পরিবার ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করে। সেই বছরে মঙ্গা আঘাত হেনেছিল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য স্থানীয়ভাবে অভাবে থাকা মানুষের কাজ সৃষ্টির কর্মসূচি নেওয়া হয়। প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে একজন মানুষের ৩০ থেকে ৪০ দিনের কাজ। গ্রামবাসীরা সভার পর সভা করতে থাকেন। কী আর কাজ থাকে চরে? অভাবের চাপে তত দিনে প্রায় সব পরিবারের একজন-দুজন পুরুষ সদস্য চর ছেড়ে নানা শহরে চলে গেছেন। সন্তান আর প্রবীণদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা নারীরাই এগিয়ে আসেন, চরের মাঝামাঝি ১৮ বিঘা জমির ওপর মাটির কেল্লা বানাবেন তাঁরা। এমন উঁচু করবেন যে মহাপ্লাবন যেন তাঁদের নাগাল না পায়।

শেষ পর্যন্ত সাত ফুট উঁচু করে বাঁধা হয় কেল্লা। নাম দেওয়া হয় কুন্দেরপাড়া বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। প্রায় ৪৫০ জন নারী-পুরুষ তিন মাস টানা কাজ করে গড়ে তোলেন চরের মধ্যে মাটির পাহাড়। ১৯৯৬ সালের বন্যায় কাজে দেয় কুন্দেরপাড়ার নারীদের এই স্বপ্নের সৌধ। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া নানা চরের হাজার হাজার মানুষ তাদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে আশ্রয় নেয় কুন্দেরপাড়ায়। কুন্দেরপাড়া ক্রমেই হয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে এক আশার দ্বীপ। এখন পর্যন্ত যত বন্যা হয়েছে, মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছে কুন্দেরপাড়ায়। কুন্দেরপাড়া পরিণত হয় চরের দুর্গে। অনেকে বলেন, চরের রাজধানী। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে শহর রক্ষার নামে স্থাপনা আর নদীর প্রশিক্ষণের ঠিকাদারি কাজে অসুখী ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তনের কাজে মন দিলে বিপাকে পড়ে কুন্দেরপাড়া ও তার লাগোয়া চর পূর্বকাটিমারীর ১ হাজার ২০০ পরিবারের প্রায় ৭ হাজার ২০০ মানুষ।

গত দুই বছরে কুন্দেরপাড়া অংশের প্রায় ৩০ বিঘা জমি আর ২০০ ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চরের প্রথম হাইস্কুলটিও এখন হুমকির মুখে। অবহেলিত জনপদের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলের পাঠ নিয়েই নানা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কয়েকজন চাকরিও করছেন। দূর-দূরান্তের চরের পড়াশোনার সুবিধার্থে গড়ে তোলা মেয়েদের হোস্টেলটি ইতিমধ্যেই নদীতে বিলীন হয়েছে। গ্রামবাসী এবার একটা শেষ চেষ্টা করতে চান। ১৯৯৩-এর সেই টগবগে সংগ্রামী নারীরা এখন অনেকেই প্রবীণ বা প্রায় প্রবীণ। হামিদা বানু দেহ রেখেছেন কুন্দেরপাড়ার মাটিতে। তাঁর স্বপ্নের কেল্লায়। কিন্তু তাঁদের সন্তানেরা, যারা একটা টেকসই চরের উপকার পেয়েছে, তারা মা-নানিদের কথায় আবার এককাট্টা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা অফিসে দেনদরবারে কাজ হয়নি। শহর রক্ষার প্রকল্প থাকলেও চর রক্ষার কোনো প্রকল্প নেই। তবে তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সঙ্গে পেয়েছে। তরুণ আবদুস সালাম তাঁর সাধ্যমতো সাহায্য আর বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। গ্রামের মানুষ নিজেরা বসেই বাঁশের বান্ডিল তৈরির ছক এঁকেছেন। কাগজের ওপর নকশা এঁকেছেন পুরোদস্তুর প্রকৌশলীদের ঢঙে। গ্রামের দিকে ঘুরে আসা ব্রহ্মপুত্রের নতুন মুখে তাঁরা বাঁধ দেবেন। পরপর তিন রেখায় বাঁশের ঘন ঘন খুঁটি পুঁতে নির্মাণ করা হয় এই বান্ডিল। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ছাড়াও অনেক শাখা নদীতে শতাব্দী প্রাচীন কম খরচের এই প্রযুক্তি ঘুরিয়ে দিতে পারে নদীর সর্বনাশা গতিপথ।

প্রাচীন এই প্রযুক্তির সঙ্গে গ্রামবাসী আর তরুণেরা বাঁশ পোঁতার কাজ করেছেন পাইলিংয়ের ঢঙে। শ্যালো ইঞ্জিনের সঙ্গে পাইপ লাগিয়ে তাতে চিকন বাঁশ সংযুক্ত করে কাজটি করা হয়। শ্যালো দিয়ে পানি উঠিয়ে পাইপের মাধ্যমে সেই পানি ছাড়লে পানির চাপে নরম বালু মাটি সরে গিয়ে বাঁশ পোঁতার কাজটা সহজ করে দেয়। এই প্রযুক্তিতে কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা সহজ হয়েছে। কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামবাসীর এই পাইলিং পদ্ধতিতে তিন সারিতে বান্ডিল স্থাপনের ফলে বর্ষার সময় নদীর স্রোত বাধা পেয়ে মূল ধারায় ফিরে যাবে। বেঁচে যাবে কুন্দেরপাড়ার জেগে ওঠা জনপদ।

গ্রামবাসীর এই স্বেচ্ছাশ্রমে এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছেন গাইবান্ধার বন্ধুসভার সদস্যরা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই স্বেচ্ছাযজ্ঞের কাজ শেষ হয়েছে ৩ এপ্রিল। তিনটি সারির এই বান্ডিল তৈরিতে সময় লাগে মোট ১৭ কর্মদিবস। প্রতিটি সারির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফুট। একটা সারি থেকে আরেকটা সারির দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। গ্রামের মানুষ শ্রম দিয়ে, বাঁশ দিয়ে, দড়ি বা তার দিয়ে সহায়তা করেছেন। তারপরেও নগদ খরচ হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। নগদ টাকার একটা বড় অংশ (৬০ হাজার টাকা) দিয়েছে প্রথম আলো। বাকি টাকা গ্রামবাসী আর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ভাঙন প্রতিরক্ষা বান্ডিল নির্মাণে কুন্দেরপাড়া চরের স্কুল, গণউন্নয়ন একাডেমির শিক্ষক-ছাত্রদের পাশাপাশি গাইবান্ধা শহরের বন্ধুসভার সদস্যদের অংশগ্রহণ গ্রামের মানুষকে আরও উৎসাহিত করেছে। প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিনিধি গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, যে বান্ডিল নির্মাণ করা হয়েছে তাতে মানুষের উপকার হবে। পানির স্রোত বান্ডিলে ধাক্কা খেয়ে সেখানে বালু জমতে সাহায্য করবে। এই বালু কুন্দেরপাড়ার ভাঙনরোধে ভূমিকা রাখবে।

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা প্রতিনিধি]

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী