শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা। শারিরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এবং সামাজিক শিশুই নির্মল পৃথিবী গড়তে পারে। শিশুর সুন্দর শৈশব এবং অনাবিল ভবিষ্যতের জন্য দরকার সঠিকভাবে বেড়ে উঠা। লেখা-পড়া, খেলা-ধুলা এবং সুন্দরভাবে তার জীবনকে আনন্দময় করতে স্বাভাবিক জীবন একান্ত কাম্য। এই সময়ই শিশুর মেধাবিকাশে আগামী দিনের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর একটি নিজস্ব জগৎ গড়ে ওঠে, তাতে আমাদের বাধা দেয়া উচিত নয়। শিশুদের মৌলিক মানবিক বিষয়ের মধ্যে চিত্ত বিনোদন একটি । তাই তার সঠিক বিকাশে সুস্থ ও শিশুবান্ধব বিনোদনের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।
চিকিৎসকরা বলেন , পিঠে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট নিয়ে শিশুরা তাঁদের কাছে আসছে। এদের প্রায় সবাই বলছে, স্কুলব্যাগের ওজন বেশি। বহন করতে কষ্ট হয়। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুলসহ সব প্রতিষ্ঠানের শিশুদের কাছ থেকেই তাঁরা এমন অভিযোগ পেয়েছেন। শিশুরা মাঝে মাঝেই পিঠব্যথায় কাতরায়। কোনো কোনো দিন ব্যথা ঘাড় বা পায়েও ছড়িয়ে পড়ে। শিশু অস্থিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসকরা বলেন, একটি শিশু তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ওজনের বোঝা বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন। এই বোঝা স্কুলব্যাগের বোঝা। এই বোঝাটা কমাতে হবে। আগে জীবন বাঁচাতে হবে, তারপর লেখাপড়া ।চিকিৎসকরা আরও বলেন,পিঠে-ঘাড়ে ব্যথার কারণ যে ভারী ব্যাগ, অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। ফলে বাচ্চাকে অনেক দেরিতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা ও পাঠ্যবই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ শিশুর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও বিশিষ্ট লেখকেরা বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শিশু-কিশোরবান্ধব নয়। পরীক্ষা খুব বেশি। প্রচুর বই, এত বইয়ের দরকার নেই। ক্লাসরুমে পড়াশোনা হচ্ছে না। তাই কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে। গাইড বই কিনতে হচ্ছে। শিশুদের বই বেশি থাকলে ব্যাগের ওজন বেশি হচ্ছে, এতে শিশুর শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া বেশি বইয়ের কারণে লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিশুরা এখন লেখাপড়াকে ভয় পায়, লেখাপড়া থেকে আনন্দটা হারিয়ে গেছে।
সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠা । সাতটায় স্কুলের ক্লাস শুরু। শেষ হয় দুপুর ১২টা নাগাদ। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় প্রায় একটা থেকে দুইটা (রাস্তায় ট্রাফিক জেম তো আছেই)। গোসল-খাওয়া সেরেই ছুটতে হয় কোচিংয়ে। বাসায় ফেরা হয় সন্ধ্যায়। দিন কেটে যায় এভাবেই। সন্ধ্যা নামার পরপরই আসেন গৃহশিক্ষক। পড়া শেষ হতে হতে সাড়ে আটটা-নয়টা। রাতের খাওয়া, স্কুলের পড়া। একটু টিভি দেখে ঘুমাতে যেতে যেতে প্রায় রাত ১২টা। সপ্তাহে ছয় দিন এভাবেই ছোটাছুটি পড়াশোনা নিয়ে। আর ছুটির দিনে সারাদিন পড়াশোনা করা । রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় নগরগুলোর বেশির ভাগ শিশুর রুটিন অনেকটা এ রকমই। অবসর বলে কিছু নেই। যেটুকু অবসর পাওয়া যায় তা চলে যায় ক¤িপউটারে গেম খেলা, কার্টুন বা টিভি দেখায়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মুক্ত বাতাসে খেলাধুলা ও বিনোদন জরুরি। অনেক অভিভাবকই এ নিয়ে চিন্তিত হলেও এর কোনো সুরাহা নেই যেন।
খুব কম শিশুই নিজের ব্যাগ নিজে বহন করে স্কুলে নিয়ে যায়। বইয়ের চাপে ব্যাগ এতটাই ভারী থাকে যে, শিশুর পক্ষে তা বহন করা সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে কিন্ডারগার্টেনের শিশুরা কতগুলো বই পড়বে, সিলেবাস কেমন হবে, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষের ওপর। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের পাশাপাশি সেখানে আরও অনেক বই পড়ানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই বেশি বইয়ে চাপের পরিমাণও বেশি। শিশুদের পড়াশোনার চাপের জন্য অনেকটাই দায়ী অতিরিক্ত বই। শুধু কিন্ডারগার্টেনই নয়, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোসহ অনেক বড় স্কুলেই পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের চেয়ে অতিরিক্ত আরও অনেক বই পড়ানো হয়, যা শিশুদের পড়াশোনায় চাপ সৃষ্টি করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার ধারায়ও এসেছে পরিবর্তন। নতুন নতুন অনেক কিছুই সিলেবাসে যোগ হচ্ছে, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া সচেতন নাগরিকমাত্রই চান তাঁর সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক, সমাজে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক। আর পড়ালেখায় ভালো ফলাফলকেই সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করার কারণে শিশুদের সব সময় পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখতে চান অভিভাবকেরা। স্কুলের পড়াশোনায় বিভিন্ন নতুন সংযোজন এবং পিতামাতার অতি সচেতনতা শিশুদের মধ্যে এক ধরনের চাপের সৃষ্টি করে যার ফলস্বরূপ শিশুদের ওপর পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়।
আগে বেশির ভাগ স্কুল ছিল খোলামেলা। শিশুরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ পেত। এখন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে কিছু সরকারি স্কুল বাদে বেশির ভাগ স্কুলেই পর্যাপ্ত খেলার জায়গা নেই। শিশুরা যতক্ষণ স্কুলে থাকছে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকছে। সেখানে কোনো বিনোদন নেই। এ কারণে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
জ্ঞানজগতে যোগ হচ্ছে নিত্য নতুন শাখা। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিশুদের স¤পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ফলে চাপও বেড়ে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে শিশুদের অনেক পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই পরীক্ষাগুলোর জন্যও পড়াশোনার আলাদা প্রস্তুতি, মডেল টেস্ট, কোচিং ইত্যাদিতে ব্যস্ত হয়ে যেতে হচ্ছে শিশুদের।ফলে শিশুদের ওপর পড়াশোনার চাপ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
শিশুদের পড়াশোনা হওয়া উচিত বিনোদন-নির্ভর, যাতে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে। সিলেবাস এমনভাবে তৈরি হওয়া উচিত যেখানে বিনোদনের বিষয়টি স¤পৃক্ত থাকে। সেজন্য প্রয়োজনে স্কুল শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাঁর মতে, পঞ্চম শ্রেণী শেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) এবং অষ্টম শ্রেণী শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এ নিয়ে অন্তত একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা উচিত এই পরীক্ষাগুলো শিশু শিক্ষায় ঠিক কতটা কার্যকর ভ‚মিকা রাখছে।
পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে। অতিরিক্ত চাপের ফলাফল আসলে ভয়াবহ। শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ার মতো ঘটনা ঘটাও বিচিত্র কিছু নয়। অনেক সময় দেখা যায় কিছু শিশু একটি নির্দিষ্ট ক্লাসের পর আর পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করতে পারে না। ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে, মনোযোগের প্রচন্ড অভাব সৃষ্টি হয়। এই ঘটনাগুলো হচ্ছে পড়াশোনায় অতিরিক্ত চাপের চ‚ড়ান্ত ফলাফল। এ ক্ষেত্রে শিশুটি ধীরে ধীরে পড়াশোনায় ভয় পেতে শুরু করে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবকই বিষয়টি গুরত্বের সঙ্গে নেন না। লেখাপড়া না করলে তাঁরা বকাঝকা এমনকি মারধরও করেন, যা শিশুর মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরাই মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে শুরু থেকেই যদি পিতামাতা সচেতন হন, তাহলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় না।
একেক শিশুর পড়াশোনার আগ্রহ, বোঝার ক্ষমতা একেক রকম। তাই সব সময় অন্য শিশুর সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা করা উচিত নয় । পড়াশোনার চাপের পেছনে অভিভাবকদের একটি বড় ভ‚মিকা থাকে। তাই তাঁদের সচেতন হতে হবে এবং কিছু বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে।সন্তান যদি ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৯৫-এর উত্তর দেয়, তাহলে তাকে বাহবা দেয়া উচিত, কিন্তু পাঁচ নম্বরের উত্তর কেন দিতে পারেনি সেজন্য তাকে ভৎর্সনা করা উচিত নয়।
শিশুকে ভালো ফলাফল করার জন্য উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যও উৎসাহিত করা উচিত । পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়া দরকার। সন্তানকে বুঝা, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান, পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলতে হবে। সে অবশ্যই বুঝতে পারবে।
সঠিক দিকনির্দেশনা যেমন শিশুকে আগামী দিনের একজন সফল মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারে, তেমনি ভুল নির্দেশনাও একটি শিশুকে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই সন্তানের যতœ নিন, পড়াশোনার জন্য কেবল চাপ না দিয়ে তাকে পড়তে উৎসাহিত করা উচিত । শিক্ষার আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী আপনার শিশুকে ¯পর্শ করুক। ভালো থাকুক, ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক প্রতিটি শিশু। বাংলাদেশে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়। শিক্ষা গবেষকদের মতে, শিশুদের পাঠদানের পুরো পদ্ধতিই নতুন করে ঢেলে শিশু উপযোগী করা উচিত। শিশু শিক্ষার যে ব্যবস্থাটা আমাদের দেশে রয়েছে, তা যথার্থ নয়। এটাতে আরো পরিবর্তন আনা দরকার, উন্নতি সাধন করা দরকার। যাতে করে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়তে পারে। এছাড়া পরীক্ষার চাপ থেকে শিশুদের মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্তশিশুদের পরীক্ষা থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্কুলের পড়া আর অভিভাবকদের চাহিদার চাপে পরে শিশুদের সোনালী শৈশবটিই হারিয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। এটা নিয়ে কোন পর্যায়েই দৃশ্যমান কোন উদ্যোগও নেই।এই কচি প্রাণগুলোর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। সকল শিশুকে নিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
সৈয়দ ফারুক হোসেন
ডেপুটি রেজিস্ট্রার,
জগন্নাথবিশ্ববিদ্যালয়
বিপি/আর এল