পার্বতীপুর প্রতিনিধি:বড়পুকুরিয়া খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার একটি বড় অংশ পাচার করা হয়েছে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। কয়লা পাচারের সঙ্গে কারা কারা জড়িত তা শিগগির খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। কয়লা গড়মিলের ঘটনায় সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে গোটা খাতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন কয়লা ‘উধাও’ হওয়ায় সন্দেহের তীর পড়েছে খনিটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সরকারি কোম্পানি বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে না দিয়ে খোলা বাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অন্তত ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন জড়িতরা। আর এ অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের জনগণ। রবিবার বড়পুকুরিয়ার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন পুরোদমে বন্ধ হয়ে গেছে। ওইদিন রাত থেকেই রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের জেলাগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরো ঘটনার আগাগোড়া খতিয়ে দেখতে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে এ বিষয়ে ‘পূর্ণ তদন্ত’ করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতেও বলেছেন তিনি।
ইতিমধ্যে ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পৃথক দুটি কমিটি। গতকাল সোমবার পেট্রোবাংলা এবং দুদকের কর্মকর্তারা খনি প্রাঙ্গণ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেছেন। পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদন আজ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস সূত্র এবং দিনাজপুরের স্থানীয় একাধিক সূত্রও জানিয়েছে, কয়লা উধাও হওয়ার ঘটনায় সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। পাশাপাশি আজ মঙ্গলবার থানায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতিও নিয়েছে পেট্রোবাংলা।
এর আগে খনিটির ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বিসিএমসিএল’র মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দিন আহমেদকে অপসারণ এবং মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও কোম্পানি সচিব) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে বদলি করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা এবং স্থানীয় কয়েকটি সূত্রের সাথে কথা বলে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা ওই এলাকায় গড়ে ওঠা তিনটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা সরবরাহ ও মজুদ নিশ্চিত করার পর অবশিষ্ট কয়লা খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারে বিসিএমসিএল। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫৭৮ টন এবং স্থানীয় খোলা বাজারে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫১২ টন কয়লা বিক্রি করে বিসিএমসিএল। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা বাজারে কয়লা বিক্রি করা হয়। ওই সময়ে প্রতি টন ১৭ হাজার টাকা দরে অন্তত ১০০ টন কয়লা বিক্রি করা হয়েছিল। মার্চে কয়লার মজুদ কমে গেলে বাইরে কয়লা বিক্রি স্থগিত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে খনি কোম্পানি।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, খনি প্রাঙ্গনে মজুদ এবং সর্বশেষ স্তরে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ হিসেবে নিয়ে তখন খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বোঝা যায়, ওই সময়ে এবং তার পরে কাগজেকলমে দেখানো হিসাবের চেয়েও বেশি কয়লা বাইরে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিক্রি করা হয়। কেননা খনির উন্নয়ন-সংস্কারকাজের জন্য গত জুন থেকে আগামী আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন বন্ধ থাকবে তা পূর্বনির্ধারিতই ছিল। এ সময়ে বিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা মজুদ আছে বলে নিশ্চিতও করে বিসিএমসিএল।
তবে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সদ্য অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০০৫ সালে এই কয়লার খনি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয় এবং এই পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সময় সিস্টেম লস বা উত্পাদন ঘাটতিকে বাদ দেওয়া হয়নি। খনি থেকে কয়লা উত্পাদনের পর কয়লাতে জ্বলীয় বাস্প থাকার কারণে পরবর্তী সময়ে ১ থেকে ২ শতাংশ কয়লা ওজনে কমে যায়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশ সিস্টেম লস ধরা হয়। সে হিসেবে যদি দেড় শতাংশ সিস্টেম লস ধরি, তাহলে এই ঘাটতি সঠিক রয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিস্টেম লস হতেই পারে। কিন্তু কয়লারতো বাহ্যিক আকৃতি আছে। ইয়ার্ডে কী পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে তা সংশ্লিষ্টরা স্বাভাবিকভাবে দেখেও বলতে পারেন। এতে এত বড় ভুল হওয়ার কথা নয়।
গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের ৫ সদস্যের একটি তদন্ত দল প্রায় ২ ঘন্টা ধরে কয়লা খনির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। পরে ওই দলের নেতৃত্ব দেয়া উপপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, খনি প্রাঙ্গণে (কোল ইয়ার্ডে) ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন কয়লা মজুদ থাকার কথা। কিন্তু রয়েছে মাত্র ২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লার কোন হদিস নেই। তিনি জানান, বিপুল পরিমাণ কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ায় এখানে প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে। সম্পূর্ণ তদন্ত শেষ করতে প্রায় ৬০ দিন সময় লাগবে। পেট্রোবাংলার তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, তাদের তদন্তেও প্রাথমিকভাবে খনি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অব্যবস্থাপনার তথ্য মিলেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ণ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সচিব, পিডিবি ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রনালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটির পূর্ণ তদন্ত করতে বলেছেন। কারণ সেখানে ২০০৫ সাল থেকে কয়লা উত্পাদন হচ্ছে। আমরা পুরোটা খতিয়ে দেখতে কাজে নেমেছি। তদন্ত ফলাফর পর্যন্ত সকলকে ধৈর্য্য ধরারও আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অবশ্যই। উনি তো আমার মন্ত্রী, এই বিভাগের মন্ত্রী।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “দুমাস আগে থেকেই বিদ্যুত্ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছিল যে, আমাদের কয়লার সঙ্কট চলছে। কিন্তু ওখানকার যে কর্মকর্তারা বলছিলেন, না কোনো সঙ্কট নেই। তখন বিদ্যুত্ বিভাগ থেকে তদন্ত দল পাঠানোর পর তথ্যটা উদঘাটন হল। এখন তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্থায়ীভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
লোডশেডিং বৃদ্ধির আশঙ্কা
এদিকে দেশে চলমান গরম আবহাওয়ার কারণে এমনিতেই বিদ্যুত্ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর মধ্যে মোট ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রে উত্পাদন বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগের আট জেলা বিদ্যুত্ সঙ্কটে পড়েছে। রবিবার থেকে ওই অঞ্চলে লোডশেডিং বাড়ার পাশাপাশি ভোল্টেজ কমে যাচ্ছে। ব
এ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। তাই এত পরিমাণ বিদ্যুতের ঘাটতি হঠাত্ করে মেটানো কঠিন। তবে গ্যাস ও তেলচালিত কেন্দ্রে উত্পাদন বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা চলছে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাসখানেক সময় লাগবে।
বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রীও বলেন, “সাময়িক ভোগান্তির জন্য জনগণের কাছে আমরা দু:খ প্রকাশ করছি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যুত্ বিভাগ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। একটা মাস ধৈর্য ধরার জন্য আমি সকলের কাছে অনুরোধ করছি।”
পিডিবি এবং নর্দার্ন ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের আট জেলায় প্রতিদিন অন্তত ৬৫০ মেগওয়াট বিদ্যুত্ প্রয়োজন। এর বেশিরভাগই বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুেকন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হত। এর বাইরে রংপুর ও সৈয়দপুরে ২০ মেগাওয়াট করে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক দুটি ছোট বিদ্যুত্ কেন্দ্র রয়েছে। এখন সিরাজগঞ্জের কেন্দ্রগুলোতে উত্পাদন বাড়িয়ে রংপুরে বিদ্যুত্ সরবরাহ শুরু হয়েছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান জানান, আগামী কয়েকদিন রংপুর এলাকায় ঘাটতি বেশি থাকবে। তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ওই অঞ্চলে বিদ্যুতের ঘাটতি ১০০ মেগাওয়াটের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হবে।
বাংলাপ্রেস/ইউএস