বাংলাপ্রেস অনলাইন: পাকিস্তানে বুধবার ১১তম সাধারণ সাধারণ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে। ব্যাপক বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার সেনাসদস্যের বিতর্কিত উপস্থিতির মধ্যেই স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হয়েছে, চলবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
দেশটির প্রায় ১০ কোটি ৬০ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের রায়ে বুধবার নির্ধারিত হয়ে যাবে কে হচ্ছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী।
ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) মধ্যে। নির্বাচন-পূর্ব একাধিক জরিপে পিএমএল-এনের চেয়ে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে পিটিআই। ভোট কারচুপির আশঙ্কা থাকলেও, জরিপের ফল ভোটের বাক্সে সত্য প্রমাণ হলে একসময়ের ক্রিকেট তারকা ইমরান খান হবেন দেশটির নতুন কাণ্ডারি। আর জরিপের ফল ভুল প্রমাণ করে নওয়াজের দল জয়ী হলে তার ভাই শাহবাজ শরিফই হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকতে পারে বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। প্রধান দু’দলের কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কিং মেকার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩৪২ আসনের মধ্যে ২৭২ আসনে সরাসরি ভোট হচ্ছে। বাকি ৭০ আসন সংরক্ষিত। কোনো দলকে সরকার গঠন করতে হলে সরাসরি ভোটে ১৩৭ আসনে জিততে হবে।
এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে একাধিক দলের মধ্যে। ভোটকে প্রভাবিত করতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন এসব দলের নেতারা। তবে সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এদিকে প্রচারের শুরু থেকেই একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা, প্রাণহানি আর নানামুখী রাজনৈতিক বিতর্কে কালিমা লিপ্ত হয়েছে এবারের নির্বাচন। বলা হচ্ছে, দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে নোংরা নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবার। এমনকি দেশটির নাজুক গণতন্ত্র বেহাত হওয়ারও আশঙ্কা করছেন অনেকে। এত অভিযোগ সত্ত্বেও প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানের এই জাতীয় নির্বাচনের দিকে মনোযোগ রয়েছে বিশ্বের বহু দেশের।
এবারের নির্বাচনে সক্রিয় ৩০টি ছোট-বড় দলের ৩ হাজার ৭৬৫ প্রার্থী লড়াই করছেন। তবে নারী প্রতিনিধিত্ব বরাবরের মতই কম। শীর্ষ তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাদের মধ্যে পিটিআইপ্রধান ইমরান খান পাঁচটি আসনে নির্বাচন করছেন। অনেক দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকের ধারণা, ৬৫ বছর বয়সী এই নেতাকে দেশটির সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসাতে চায়। এ জন্য ইমরানের প্রতিপক্ষদের ঠেকাতে সেনাবাহিনী তার দলকে সহযোগিতা করছে। পিটিআইর প্রতি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দা, তালেবানসহ বেশকিছু বিতর্কিত সংগঠনের সমর্থন রয়েছে বলেও কথা উঠেছে। এর আগে ইমরান খান ১৯৯৭ সালে দুই আসনে নির্বাচন করে হেরে যান। ২০০২ সালে এক আসনে ও ২০১৩ সালে এক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেন তিনি। খাইবার পাখতুনখোওয়া প্রদেশে ইমরানের দল জোট সরকার পরিচালনা করছে। আর বিদায়ী পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল পিটিআই। বর্তমান সংসদে পিটিআইর আসন ৩২টি।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির জেরে ক্ষমতাচ্যুত তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নির্বাচনে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন। এমনকি নিজের দলের প্রধানের পদেও নেই তিনি। এখানেই শেষ নয়, দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন নওয়াজ। সেনাবাহিনী তার দলকে ফের ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলে অভিযোগ করে আসছেন তিনি। নওয়াজের দাবি, সেনাবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করা আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাওয়ায় সেনাবাহিনী তার ওপর নারাজ। নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তার দলের প্রায় ১৭ হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলছে।
তার দল পিএমএল-এনের বর্তমান প্রধান হেভিওয়েট প্রার্থী শাহবাজ শরিফ চারটি আসনে নির্বাচন করছেন। লাহোরে জন্ম নেওয়া ৬৭ বছরের এই নেতা নওয়াজেরই ছোট ভাই এবং পাঞ্জাব প্রদেশের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী। বলা হচ্ছে, নওয়াজের দিকে তাকিয়েই শাহবাজকে ভোট দেবেন পিএমএল-এন সমর্থকরা। বর্তমান সংসদে পিএমএল-এনের আসন সংখ্যা ১৮২।
গুঞ্জন রয়েছে, পিএমএল-এনের মতো পিপিপিকেও ভালো নজরে দেখছে না দেশটির সেনা কর্তৃপক্ষ। এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচন করছেন দলটির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল জারদারি ভুট্টো। ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা তিনটি আসনে লড়ছেন। বিলাওয়াল দেশটির প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বোমা হামলায় মা বেনজির নিহত হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে আসেন। বিলাওয়ালের বাবা পিপিপির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি লড়ছেন একটি আসনে। তার বিরুদ্ধে তিনটি ব্যাংকে অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে বেনজির ভুট্টো নিহত হওয়ার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে পিপিপি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন জারদারি। বর্তমান সংসদে পিপিপির আসন ৪৬টি।
এবারের নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানে একবার বেসামরিক, একবার সামরিক- এভাবেই শাসনের পালা চলছে। তবে দেশটির ইতিহাসে এবারই দ্বিতীয়বারের মতো এক বেসামরিক সরকার পূর্ণ মেয়াদ শেষে আরেক বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে যাচ্ছে।
বাংলাপ্রেস/আর এল