– এবিএম সালেহ উদ্দীন
শিল্পী হচ্ছেন রসস্রষ্টা। শিল্পকলার উৎকৃষ্ট কারিগর। শিল্পবোধ মনের চেতনায় যিনি সৃষ্টি করেন রং তুলির স্পর্শে পৃথিবী ও প্রকৃতির ছাপছবি ও মানুষের শিল্পকর্ম মানুষ ও প্রকৃতিকে ঋদ্ধ করে তোলে।মনন ও সৃজনের সোপানে শিল্পীর সৃষ্টি সম্ভারে সমাজ, দেশ-রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। শিল্পের মাধ্যমে লোভ, হিংসা,দ্বেষ,জিঘাংসা,মানুষের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন,মানববিধ্বংসী মনুষ্যত্ব-বিনাশী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ প্রতিবাদ প্রকাশ করা হয়। শিল্প নানা রকমের হতে পারে। সাহিত্য, সঙ্গীত ও কবিতার মত শিল্পের বহুমাত্রিক ভাষা আছে। শৈল্পিক নৈপূণ্যতা প্রকাশের সুযোগ আছে। আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শিল্পকলা ও শিল্পের রূপায়নে শিল্পীর মন ও স্বভাব।
শিল্পী কি চান? তিনি কি শুধু নিজের সুন্দর কাজকে নিয়েই সন্তষ্ট থাকেন? শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে অপরের হৃদয়কে নাড়া দেন। অপরের হৃদয়কে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। শিল্পী চান মানুষের ভিতরের মানুষকে আবিষ্কার করতে।
আসলে একজন শিল্পীর সুখ, আনন্দ তৃপ্তির বৈচিত্র সম্ভারের মাধ্যমে পৃথিবী, প্রকৃতির সুন্দরতম দিকগুলো ফুটে ওঠে। তেমনই মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনার অন্তরে স্থায়ী আসন গেঢ়ে নিতে পারলেই একজন শিল্পীর পূর্ণতা আসে। মানবভূন নির্মল ও শান্তিময় হয়ে ওঠে। মানুষের অন্তরে প্রেম ও ভালোবাসার সৌন্দর্য ভরে ওঠে কানায় কানায়। সমাজ ও দেশ সচকিত সৌকর্যময় হয়ে ওঠে। মোটকথা হলো শিল্পী মানসে সৃজনের যে শক্তি আছে, তদ্বারা মানুষের কল্যাণ সাধনই তার প্রধান লক্ষ্য।
নিজের মনের ক্ষুধা মেটানোর মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। এতে নিজেকে বিশালতার পরশ থেকে দূরে রাখা হয়। উত্তম আদর্শবোধ থেকে বন্চিত রাখা হয়। নিজেকে সংকীর্ণতর থেকে আরও বেশি সংকীর্ণ করে তোলে।
পৃথিবীতে এলাম, খাইলাম-দাইলাম নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুখানন্দে গা ভাসিয়ে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে চলে গেলাম। কারো সুখ-দু:খের সাথে যুক্ত হ’লাম না। কারো কল্যাণ ও উপকারে তথা মানবতার স্বার্থে নিজেকে কোন কাজে লাগলাম না। সেটাই মূলত: কৃপণতা ও অমানবিকতা। কোন কৃতিত্ব নেই এতে।
বলছিলাম শিল্পীর কথা। চারুশিল্পী ও কারুশিল্পের কথা। একজন সত্যিকার শিল্পী চোখের মনিতে পৃথিবী,প্রকৃতি,বিশ্ব প্রাণীকুল এবং মাটি ও মানুষকে ধারণ করেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে মানুষকে জুড়ে দিতে চান। চোখের আলোয় দেখাতে পান মানুষের মন। এটি শিল্পীর স্বভাবসিদ্ধ কাজ। শিল্পের দ্বারা পরিলক্ষিত হয় বৈচিত্রের বহুরূপ অবলোকন।
ক’দিন আগে নিউ ইয়র্কে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র নিউ ইয়র্ক কর্তৃক আয়োজিত মেলা চলাকালীন সময়ে নির্ধারিত স্কুলের বেইসম্যান্টর একটি কক্ষে প্রদর্শিত হয়। ওই নির্জন অগম্য আন্ডারগ্রাউন্ড স্থান নির্বাচন ছাড়া উপরে প্রদর্শনীটি কোন একটি জনসমাগম স্থলে হতে পারত।তবুও কৃতিমান শিল্পীদের মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনীটি ছিল আমার কাছে আকর্ষণীয়। মনে হলো সেখানে গিয়ে ঠকি নাই। কারণ সাত কৃতিমান শিল্পীর অঙ্কিত দেয়ালে টাঙানো চারটি করে মোট আটাশটি বিশেষ ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল।
সেজন্যেই হৃদয়ের টানে মেলায় গিয়ে কিছুক্ষণ ছিলাম। সেখান থেকেই আবার আটলান্টিক সিটির বঙ্গ সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষ্যে চলে যেতে হয়েছিল।
উল্লেখ্য সাত শিল্পীর মধ্যে পাঁচজনই আমার সজ্জন ও ঘনিষ্ঠ। তারা হলেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান রোকন, সৈয়দ আজিজুর রহমান, কায়সার কামাল ও জেবুন্নেছা হেলেন। পাঁচজনই সৃজনধর্মী মেধাবী ও মননশীল আর্টিস্ট। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করা। তাদের আঁকা ছবির সংখ্যা অনেক। ঢাকার বড় গ্যালারি ছাড়াও নিউ ইয়র্কের ‘সোহ ‘এলাকা ও মিডটাউনের গ্যালারিপাড়ায় তাদের সো হয়েছে। এদের মধ্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কায়সার কামাল, মাহমুদুল হাসান রোকন এবং আলম টিপু মিলে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ড সিটিতে ‘আর্টিস্ট রান’ নামে একটি সুপরিসর সুন্দর ও চিত্তমনোহর গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশেষ করে বন্ধুবর বিশ্বজিৎ চৌধুরী ও কায়সার কামাল জুয়েল যে শ্রম ও মেধার পরিস্ফূটন ঘটিয়েছিলে; সেটির তুলনা হয় না। ওদের সংগে আরও ছিলেন জেবুন্নেছা হেলেন ও মাহমুদুল হাসান রোকন।গ্যালারিটি সৌকর্যময়তার দিক এতই সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক ছিল তা কখনও ভুলবার নয়। সেটি গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে ওদের শিল্প মন ও স্বভাবের একটি পরিচ্ছন্ন ছাপ ছিল।
সেখানে নিউ ইয়র্কে মূলধারা ও বাংলাদেশের বিখ্যাত আর্টিস্টদের সো হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সেই গ্যালারিটি তারা স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারেননি। যাই হোক এবারের সদ্য অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহনকারী আরও দুইজন ছিলেন কানিজ আকবরী ও রুদ্র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তারা আমার পরিচিত না হলেও ওরা যে নামি দামি শিল্পী সন্দেহের অবকাশ নেই। অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকেরই ছবি ঢাকা ও নিউইয়র্কের কয়েকটি বিখ্যাত স্থানে একাধিকবার প্রদর্শিত হয়েছে।
সমগ্র আমেরিকায় তাদের সমসাময়িক একটি আর্টিস্ট গ্রুপ আছে। তন্মধ্যে বন্ধুবর বিশ্বজিৎ চৌধুরী’র নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশী আমেরিকান আর্টিস্ট ফোরাম’ নামে একটি শক্তিশালী সংগঠন গত কয়েক বছর ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের যুক্ত আছেন আরও বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান আর্টিস্ট। ‘আর্টিস্ট ফোরাম ‘বিভিন্ন সিটিতে অবস্থানরত: আর্টিস্টদের সাথে একটা সমন্বয় রক্ষা করেই চলছে তাদের কাজ।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের স্রষ্টা ও আলোকিত মানুষের মশালবাহি প্রবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ উক্ত প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। চিত্র প্রদর্শনীতে নেতৃত্ব দানকারী কায়সার কামাল জানান উল্লেখিত সাত শিল্পীর ছবি ছাড়াও আগত দর্শকদের মধ্য থেকে তাৎক্ষণিক আঁকা ছবি পাশের দেয়ালে প্রদর্শিত হয়েছে।
উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে আর্ট এর দিকে আগ্রহী করে তোলা।তারই প্রক্রিয়ায় নতুনদের অনেকেই চিত্রাঙ্কনে অংশ গ্রহন করেছে।ইহা একটি ইতিবাচক উদ্যোগ।চিত্রাঙ্কন কিম্বা ছবি আঁকা শুধু ফ্যাশন আর বিনোদনের জন্য নয়।এটি মানুষের জীবনের অনুসঙ্গ। পৃথিবীর প্রায় দেশেই শিক্ষায় চিত্রকলা বিভাগ চালু আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনিস্টিটিউট এখন একটি স্বয়ংসম্পন্ন ফ্যাকাল্টি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা কৃতিমান শিল্পীদের উদ্যোগে বহি:র্বিশ্বে চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন আমাদের শিকড় সন্ধানী মনকে উচ্ছ্বসিত করে তোলে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবী অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের আর্টিস্টদের মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেটি খুউব খুশি ও আনন্দদায়ক খবর। সবাইকে শুভেচ্ছা।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক প্রবাসী কবি ও প্রাবন্ধিক