—পরাগ সঞ্চিতা
রাজশাহী ইউনিভার্সিটির সহপাঠীরা এক রিইউনিয়নের ম্যাগাজিনের জন্য লেখা চেয়েছে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ছেড়েছি কত বছর হলো? আমি হিসাব করতে চাইনা। নিজের বয়স মনে পড়ে যায়। চল্লিশ উতীর্ণ হবার পর থেকে আমি আমার বয়স অস্বীকার করে চলেছি। কোথা থেকে শুরু করা যায়? মনে পড়ে কাক ডাকা ভোরে বাস স্টপে দৌড়ানো, তাড়াহূড়োতে মাঝে মাঝে ওড়না ভুলে যেতাম, আবার রিক্সা নিয়ে বাড়ি ফিরে ওড়না নিয়ে পরের বাস ধরে যেতে যেতে কাদির ভূঁইয়া স্যারের ক্লাসে দেরী হয়ে যেত। যা ছিল বিগ নো নো। সেই সময় তো আমাদের কোন সেল ফোন ছিলনা যে রিমাইন্ডার সেট করে রাখবো- “ওড়না নিতে ভুলোনা”। আর কাদির ভূঁইয়া স্যারের ক্লাসে দেরী হলে- তার ফল তো সবারই জানা, হয়তো উনি ঢুকতেই দেবেননা ক্লাসে। ক্লাসে কথা বলা ছিল একদম নিষিদ্ধ, দেরী করে ক্লাসে ঢুকা ছিল ট্যাবু, আরো ছিল বিভিন্ন বিধি-নিষেধ। একটু অনিয়ম হলেই স্যার অনেককেই ঊচ্চ স্বরে বকাবকি করতেন—“শার্টের স্লীভ গুটিয়ে ক্লাসে এসেছো কেন? তুমি কি মারামারি করতে যাবে”? ক্লাস থেকে বের হয়ে সহপাঠী বন্ধুদের সবার সামনে অপমানিত হয়ে অনেকেই মন খারাপ করতো। তখন স্যারের অতিরিক্ত শাসনকে বাড়াবাড়ি মনে হতো; কিন্তু আজ এই পরিণত বয়সে এসে বুঝি উনার ওই শাসনের ভেতরে লুকানো ছিল গভীর জীবন শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা। মনে পড়ে স্যারের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ ছিল কতটা জীবন ঘেঁষা, উনি বলতেন– “হল ওয়েতে দেখবে কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে হেটে যাচ্ছে স্যান্ডেলে বাজে শব্দ করতে করতে, অথচ দামি বেশ-বাস, এর মানে কি? মানে হলো সাংস্কৃতিক দিক থেকে ওই ছেলে বা মেয়েটি এগিয়ে যায়নি, শুধু বাহ্যিক দিক থেকে এগিয়েছে”। তারপর জীবন থেকে নেয়া এই উদাহরণকে সমাজে প্রয়োগ করে বলতেন-” একই ভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যতই আধুনিক, উন্নত প্রযুক্তি দাও না কেন তাদের মন-মানসিকতা, সংস্কৃতি উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে যেতে পারবেনা সমাজ বিবর্তনের ধাপ এড়িয়ে।” কত গভীর ব্যাখ্যা! বন্ধুদের সাথে রাজনীতি আলোচনাতে আমরা স্যারের ব্যাখ্যা প্রয়োগ করতাম – “মনে নেই সার কি বলেছেন? তাহলে স্যারের তত্ত্ব অনুসারে-পাকিস্তানকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার দেয়া আর ছোট বাচ্চার হাতে গান দেয়া হলো সমান কথা, বাচ্চাটি জানেনা গানের প্রয়োগ, পাকিস্তানের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আগে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এগুতে হবে, জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, উন্নত প্রযুক্তি সন্মন্ধে ওদের সচেতনতা তৈরী করতে হবে” এভাবে চলতো যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির ঝড়। আমেরিকাতে আসবার বহুদিন পরে আমার এক আত্মীয় দুঃখ করে বলছিলো যে উনার ছোট ভাইকে ফ্যামিলি ইম্মিগ্রাশনে আমেরিকাতে নিয়ে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু আমেরিকার জন্য সে উপযোগী নয়, এখনো স্যান্ডেল ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হাটে, স্মার্টনেসের অভাবে কোনো কাজে টেকে না ইত্যাদি। কাদের ভূঁইয়া স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের গুণী শিক্ষকেরা এমনভাবে আমার মস্তিষ্কে সমাজবিজ্ঞানের পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে এদেশে আসার পরে সমাজবিজ্ঞান নিয়েই গ্রাজুয়েশন করলাম। শুভাকাঙ্খীরা অনেকেই উপদেশ দিয়েছিলেন এদেশে সহজে চাকুরী পাওয়া যায় এমন কোনো মেজর নিতে, যেমন কম্পিউটার সাইন্স, ডাটা এডমিন্সট্রেশন ইত্যাদি। সব উপদেশ উপেক্ষা করে অন্য কোনো মেজর না নিয়ে সমাজবিজ্ঞানেইপড়ালেখা শেষ করলাম, আর সমাজবিজ্ঞানেরপ্রতি দৃঢ ভালোবাসার জয় হলো।
এবারে বলি সহপাঠীদের কথা, শুরুতে হলের ছেলেমেয়েদের সাথে কোথায় যেন একটা সূর ছেড়া ভাব ছিল, ছেলে মেয়েগুলো সঙ্গত কারণেই নিজেদের মধ্যে খুব ভাব রেখে চলতো। আর ছিলাম আমরা শহরের ছেলে মেয়েরা, মানে যারা ক্যাম্পাসে রেসিডেন্সিয়ালহলে থাকতামনা, বাড়িতে থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা করতাম। তারপর ছিল ইউনিভার্সিটিরক্যাম্পাসের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ছেলেমেয়েরা। মোটামোটি এই তিনটি বিভাগ। কিন্তু সেই সতেরো-আঠারো বছর বয়স থেকে দীর্ঘ সাত আট বছর যখন একসাথে প্রতিদিনের দেখা -শোনা আর জীবনাচারণ তখন কখন যে তথাকথিত মনগড়া বিভাজন ভুলে আমরা সবাই এক হয়ে গেলাম তা আর মনে নেই। এখন যখন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কোনো সহপাঠীকে ফেসবুকে দেখি (এই মুহূর্ত ভৈগোলিক দূরত্তের কারণে এটাই আমার একমাত্র দেখাশোনার মাধোম), তখন মোনটা চনমনে হয়ে যায়- হ্যা ঐ তো ও, ওকেতো চিনি, সেই চেনা মুখ, চেনা হাসি। দিনা , আফরোজা, এনাম, শরীফ, বাদল, খলিল, রফিক, পাপিয়া, বাপি, তন্দ্রা, স্টিভেন, বিপুল, প্রণব, হেনা, লাকি কত চেনা মুখ, কত কাছের বন্ধুরা আমার। মনে পড়ে এনাম, ডাবলু, আর আমার একাডেমিক প্রতিযোগিতা, কে কত ভালো গ্রেড পেতে পারে। কিন্তু যখন ডিপার্টমেন্টেরসামনে গাছের নিচে একসাথে বসে আছি, বা একসাথে প্যারিস রোডে হাটছি, অথবা এনামের সাথে লাঞ্চ করছি, কোনো কথাই নেই গ্রেড নিয়ে! কত ব্যাক্তিগত কথার লেনদেন, কত নির্ভরতা। কথা ছিল লাইব্রেরিতে প্রফেসর ঝর্ণা নাথের ক্লাসের জন্য রিসার্চ করবো- হটাৎ সিঁড়িতে দেখা হলো পাপিয়ার সাথে, বললো তোর বাড়িতে যাবো তোর মায়ের হাতের রান্না খুব মজা; চললাম দুজনে বিনোদপুর থেকে রিক্সায় উপোশহরে আমাদের বাসা অয়নান্তের পথে, আর যেতে যেতে কত কথা কত আলাপ। এই সদূর প্রবাসে যতই নতুন বন্ধুত্ব হোকে না কেন, রাজশাহী ভার্সিটির দীর্ঘ কালের বন্ধুত্বের সাথে তুলনা চলেনা।
মনে পরে লিলন ভাইয়ের কথা. তোবারক স্যারের ক্লাসে যখন টেলকোট পার্সন্স এর তত্ত্বের জটিলতা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি তখন এগিয়ে এলেন সিনিয়র ভাই লিলন। অবলীলাতে দিয়ে দিলেন উনার নোটগুলো, গোটা গোটা হাতের পরিচ্ছন্ন লেখা, যথাযথ বিশ্লেষন। চটপটে এই মানুষটাকে বহু বছর পরে টিভিতে দেখলাম, তাঁর মৃত্যু সংবাদ, নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেই সংবাদ। বাংলা টিভি দেখা হয়না, সেদিন সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াতে গেছিলাম, ভাবীদের সাথে গল্পের মাঝে কানে এলো রাজশাহী ইউনিভার্সিটির শিক্ষক… বিস্ময় আর শোকে আমি থ হয়ে গেলাম।
উত্তরাঞ্চলের কোনো এক গ্রামের এই মেধাবী মানুষটি কত আশা নিয়ে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে এসে- কত পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাঁর লক্ষে পৌঁছেছিলেন। কী এমন অন্যায় করলেন যে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারালেন? নিজের সন্তানদের দিকে চেয়ে দেখলাম, মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো, আজ যদি আমি ওখানে শিক্ষকতা করতাম ? বাক স্বাধীনতা চর্চার কারণে কী আমাকেও ওভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হতো? তবুও স্বার্থপরের মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম আমার জীবনের পথ নির্দেশনা জন্য। আবার চলে আসে ডক্টর ভূঁইয়ার কথা, আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার ভেতরেই এখনো বেশ কিছু আদিবাসী মানবগোষ্ঠীর বসবাস, কিন্তু একই সময়ে, একই স্থানে থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী মানুষেরা পিছিয়ে আছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতার পরিমাপে। অথাৎ লিলন ভায়ের হত্যা প্রমান করে প্রগতি আর বর্বরতা একই স্থানে, একই কালে সহ-অবস্থান করছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ শিকার হলো বর্বরতার কাছে , পরাজয় হলো মানবতার, স্বাধীনতার। আমি মনে করি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সমাজ বিবর্তনের স্তরে পিছিয়ে থাকলেও মানবতার দিক থেকে এই সব বর্বরদের থেকে উর্ধে অবস্থান করছে।
আগে স্বাধীনতা শব্দের শুধু রাজনৈতিক অর্থটি বুঝতাম, এখন জীবন বোধ শিখিয়েছে স্বাধীনতা শুধু অরাজকতা থেকে, বা স্বৈর-শাসন থেকে নয়, স্বাধীনতা হতে পারে যে কোনো হীনমন্যতা থেকে, হিংসা থেকে নিজের মুক্তি, অথবা কাউকে ক্ষমা করে দেবার মধ্যেও রয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। আমাদের প্রতিটি মানুষকে আগে স্বাধীন হতে হবে নিজ নিজ হিংসা, কলুষতা, আর হীনমন্যতা থেকে তাহলেই আসবে জাতির স্বাধীনতা। শুধু রাজনৈতিকভাবে দেশের স্বাধীনতা নয়; বাক্তি-মানুষ এবং মননের স্বাধীনতা, মানবতার স্বাধীনতা ছাড়া দেশের স্বাধীনতা মূল্যহীন।
আমি হলফ করে বলতে পারি—আমার সহপাঠী বন্ধুরা যে যেখানেই থাকুক, সবাই কোন না কোনো ভৱে নিজের সাধ্য মতো মানবতার সেবায়, মনুষত্বের প্রগতিতে নিবেদিত । এমনকি যে সহপাঠী বন্ধুরা মাতৃত্বের কারণে পেশা-জীবন ছেড়ে ঘরকন্নার মহা দায়িত্ব পালনে ব্যাস্ত; আমি দিব্বি করে বলতে পারি তারা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরকে উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্রতে নিয়োজিত। আমার উচ্চ-শিক্ষিত বন্ধুরা নেপোলিয়নের কথামতো শিক্ষিত জাতি তৈরী করে চলেছে নিজেদের অজান্তে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট প্রবাসী। তার পুরো নাম রওনাক আফরোজ