হাফিজুর রহমান হাবিব,তেঁতুলিয়া(পঞ্চগড়)প্রতিনিধি: শরতের পরিস্কার নীল আকাশ। নীল আকাশে ভাসমান খন্ডখন্ড মেঘ। মেঘ কেটে রোদের ঝিলিক মারে সাদা কাশবনের উপর। হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খায় কাশবন। এও যেন আরেক মনোমুগ্ধকর আবেগঘন দৃশ্য। মন কেড়ে নেয় যেকোন প্রকৃতি প্রেমিকের। হেমন্তের মিষ্টি রোদে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মেতে উঠে দেশের উত্তরের হিমালয় পাদদেশে অবস্থিত প্রকৃতির মায়াকন্যা তেঁতুলিয়া। নিবিড় শান্ত প্রকৃতির উত্তরের এ জনপদ প্রতিবছর শরৎ-হেমন্ত-শীত ঋতুতে সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় দর্শনার্থীদের সামনে।
তিন দিকে প্রতিবেশী ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার সীমান্তবেষ্টিত দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় হেমন্ত জুড়ে খুব কাছে দেখা যায় নেপালের আকাশচুম্বী হিমালয় পর্বত; ভারতের পাহাড়কন্যা দার্জিলিং আর মনোমুগ্ধকর কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই নান্দনিক গিরি-সৌন্দর্যের সঙ্গে আছে তেঁতুলিয়ার নিজস্ব ঐতিহ্যিক স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পিকনিক কর্নার, ও আনন্দধারা পার্ক, সীমান্তবেষ্টিত ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার সার্চলাইট, নদী মহানন্দা, পাথর ও চা-শিল্প। ডাকবাংলো পিকনিক কর্নারে অবস্থিত সাদিয়া গিফট কর্নারে পাবেন তেঁতুলিয়ার শ্রেষ্ঠ চা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অর্গানিক গ্রীন টি।
হেমন্তের এই সময় নির্মল আকাশে দেখা মিলছে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়। আকাশচুম্বি হিমালয় দেখে চোখ জুড়াতে অনেক পর্যটক ছুটে আসেন তেঁতুলিয়ায়। এখান থেকে খুব কাছে স্পষ্ট দেখা যায় হিমালয় পর্বত। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের গিলগিটে সিন্ধু নদী থেকে শুরু করে ভারত, তিব্বত, নেপাল, পূর্ব ভারত ও ভুটান হয়ে দণিপূর্ব তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের দণিাঞ্চলীয় বাঁক পর্যন্ত বিপুল স্থলভাগ জুড়ে অবস্থান হিমালয় পর্বতের। সমভূমি থেকে সারিবদ্ধ অনুচ্চ পাহাড়ের ভিত ধরে উচ্চ থেকে আরও উচ্চে উঠে গেছে হিমালয়ের শ্রেণি আর তার অভ্রবেদী চূড়াশৃঙ্গ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সুবিখ্যাত মাউন্ট এভারেস্ট (৮,৮৪৮ মিটার), মাউন্ট কে-টু (৮,৬১০ মিটার) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৫ মিটার)।
হিমালয় পর্বতের পাদদেশে বলে দেশের এই উত্তর জনপদে শীত হয়ে ওঠে মাত্রাতিরিক্ত। তীব্র শীত পড়ে এখানে। কুয়াশায় ঢেকে যায় পুরো অঞ্চল। ভোরের সোনালি রোদে শিশির হয়ে ওঠে মুক্তোদানা। বিশাল এই উপমহাদেশে তুষার-হিমবাহের একটিই আস্তানা- হিমালয়। এর গগণস্পর্শী সুউচ্চ চূড়াগুলো স্থায়ীভাবে জমাট বরফের বিস্তীর্ণ আস্তরণে ঢাকা; সেখান থেকে নেমে আসছে অসংখ্য ছোট-বড় হিমেল রসনা যা হিমবাহ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে চিত্তাকর্ষক কয়েকটি হিমবাহ হচ্ছে ২৬ কিমি দীর্ঘ জেমু (সিকিম) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (দৈর্ঘ্য ১৬ কিমি)। তা ছাড়া উত্তর-পূর্বে আসামের পর্বতমালা, উত্তরে মেঘালয় মালভূমি ও অধিকতর উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থাকার এখানে শীতের তীব্রতার অন্যতম কারণ।
বীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, যার উচ্চতা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট। ভারতের সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার রয়েছে চমকপ্রদ এক ইতিহাস! কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য এবং টাইগার হিলের চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য উত্তরের পর্যটনকন্যা তেঁতুলিয়া: হেমন্তের রোদে একদিকে দৃশ্যমান নেপালের আকাশছোঁয়া হিমালয় পর্বত, ভারতের স্বপ্নপুরী দার্জিলিং আর অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্যদিকে রয়েছে তেঁতুলিয়ার অপরূপ সৌন্দর্য।
বিশেষ করে সীমান্তের তীর ঘেঁষা ভারত-বাংলাদেশের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর তীর থেকে চোখ জুড়িয়ে দর্শন করা যায় আকাশছোঁয়া হিমালয় পর্বত, পর্বতশৃঙ্গকে জড়িয়ে থাকা নান্দনিক সৌন্দর্যকন্যা দার্জিলিং ও কাঞ্চনজঙ্গা। উত্তরের বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট এবং দেশের অন্যতম স্থলবন্দর। এ বন্দর থেকেও চোখ মেলে দেখা যায় দৃশ্যমান আকাশছোঁয়া হিমালয়, দার্জিলিং ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। এদিকে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই পর্যটকরা মনোমুগ্ধকর এই দৃশ্য দেখতে জড়ো হচ্ছেন তেঁতুলিয়ার ডাকবাংলোতে।
কেউ এসেছেন বন্ধুদের সাথে। আবার কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। মহানন্দার তীর থেকে কেউ তৃপ্ত দৃষ্টিতে দেখছেন হিমালয়ের দৃশ্য আবার কেউ মুঠো ফোনের সাহায্যে তা ক্যামেরা বন্দি করছেন। কেউ বা তুলছেন সেলফি। মহানন্দার পাড় থেকে এভাবেই চোখের সামনে প্রকৃতির অপরূপ চিত্রছবি অবলোকন করে পর্যটকরা।
সূর্যের আলোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সময় হিমালয়ের রূপও পরিবর্তিত হয়। যা প্রকৃতিপ্রেমিদের আরো মুগ্ধ করে। উত্তর আকাশে দেখতে পাওয়া নয়নাভীরাম হিমালয় মূলত বরফে আচ্ছাদিত শুভ্র মেঘের মতো লাগে। তার সাথেই রয়েছে পিরামিডের মতো এভারেস্টের চূড়া। নিচের অংশে কালো ও সবুজ আকৃতির পাহাড়টি মূলত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পঞ্চগড় সদর থেকে আগত ফটোগ্রাফার আব্দুল্লাহ আল-আমিন আবির জানান,তেঁতুলিয়া থেকে প্রতিবছরই হিমালয়ের দৃশ্য ধারণ করি। এবার এসেছি দৃশ্য ধারণ করতে। তবে এবার আকাশ মেঘমুক্ত আকাশ হওয়ায় বেশ স্পষ্ট দেখা মিলছে। তেঁতুলিয়া স্থানীয় সংবাদকর্মী বলেন,গত কয়েকদিনের বৃষ্টির পর আজকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূর্লভ দৃশ্যের দেখা মিলছে।
আশা করছি এবছর আরো কিছুদিন এ দৃশ্যের দেখা যাবে এবং বেশি পর্যটকের মিলন মেলায় পরিনত হবে। গত কয়েকদিন থেকে তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার খুব ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। যদিও বিগত মাস থেকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অবলোকন করতে আসছেন। তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু জানান, প্রতি বছর শীতকালে তেঁতুলিয়ায় হাজার হাজার পর্যটক খালি চোখে হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসে। এখানে এছাড়াও পিকনিক স্পট ও চা বাগানসহ কিছু দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। যা সহজেও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে তেঁতুলিয়া দেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।
বিপি/কেজে