সুলতানা মাসুমা,লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি: আমার স্বামীকে তিন তিন বার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েচিল। শেষমেশ তারা পরিকল্পিতভাবে গাড়িচাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। হত্যা মামলা করেও এখন হুমকির মুখে আছি। হত্যাকারীরা আমাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বামী হত্যার বিচার না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো। ‘
বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে এভাবেই বলছিলেন লক্ষ্মীপুরে হাজেরা বেগম শান্তা নামে এক গৃহবধূ তার স্বামী বেলাল হোসেন (৪০) হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে।
তিনি অভিযোগ করেন, স্বামী নিহতের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তারা এখন নানারকম হুমকি দিচ্ছেন।এ সময় তিনি এবং তার শ্বাশুড়ি হাজেরা (৬৮) বেলালের ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নিহত বেলাল সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরভূতা গ্রামের মৃত আবদুল মজিদের ছেলে। তিনি নারিকেল-সুপারির ব্যাবসা করতেন। মুনতাহা (৬) ও ইসমাইল হাসান (৩) নামে তার দুই সন্তান রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৬ জানুয়ারি বিকেলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চাপা পড়ে তার বেলাল হোসেনের মৃত্যু হয়। লক্ষ্মীপুর শহর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
স্ত্রী হাজেরা বেগম শান্তা দাবি করেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বেলালের মাথা, পিঠ ও বাম পায়ের হাঁটুর ওপরসহ মরদেহের বিভিন্ন অংশের ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।
এদিকে স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় সদর মডেল থানায় ৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন শান্তা। মামলার আসামিরা হলেন- সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ গ্রামের মো. সুমন, তার ভাই রিপন হোসেন, শিপন হোসেন, একই এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন ও চরভূতা গ্রামের তারেক হোসেন।
তাদের সঙ্গে আগে থেকেই পৈত্রিক জমি নিয়ে বিরোধ ছিল বেলালের। গত বছর তিনবার প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। তিনি থানায় জিডিও করেছিলেন।
শান্তা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর ‘মামলা হলে’ মরদেহ ময়নাতদন্তের নামে কাটাছেঁড়ার ভয় দেখায় আসামি পক্ষের লোকজন। পরে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে যাই। কিন্তু দাফনের আগে গোসল করানোর সময় তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। আমরা থানা পুলিশকে জানালে পুলিশ পরদিন জেলা সদর হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত করে।
এজাহার সূত্র জানা গেছে, বেলালদের সঙ্গে অনেক বছর ধরে সুমনদের জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছে। এনিয়ে বেলালের বাবার সঙ্গে তাদের একাধিক মামলা লক্ষ্মীপুরে আদালতে চলমান রয়েছে। বাবার মৃত্যু পর বেলাল মামলাগুলো তদারকি করতেন। এতে আসামিরা প্রায়ই তাকে হত্যার হুমকি দিত। গত ৪ জানুয়ারি ভোরে বেলালের বর্গাদারে চাষকৃত জমিতে আসামিরা এসে বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে চাষকৃত ৪ একর জমির সবজি কেটে বিনষ্ট করে তারা। তখন বাধা দিলে তারা বেলালকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেয়। সবজি বিনষ্টের ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয়।
৬ জানুয়ারি সকালে বেলাল প্রকাশিত সংবাদের পত্রিকা সংগ্রহের পর সদর মডেল থানায় জিডির উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়। দুপুর ১২টার ২১ মিনিটে আসামি তারেক মোবাইল ফোনে বেলালকে কল দিয়ে কাছে কোথায় আছে জানতে চায়। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে লক্ষ্মীপুর শহর পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার স্টেডিয়াম সড়কের মুখে দুর্ঘটনায় বেলালের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন রটানো হয়, বেলাল সিএনজি যাত্রী ছিলেন। এসময় দ্রুত গতির একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা পাশ থেকে তাকে ধাক্কা দেয়। তাৎক্ষণিক অটোরিকশা চালক পালিয়ে যায়। এতে মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
কিন্তু বেলালের স্ত্রী হাজেরা বেগম শান্তাকে চালক জানান, তার সিএনজি অটোরিকশায় বেলালসহ ৪ যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার পরপরই বাকি ৩ জন পালিয়ে যায়। পরে তিনি (চালক) নিজেই বেলালকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
সংবাদ সম্মেলনে শান্তা বলেন, আমার স্বামী যে সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন তার চালক আসামিদের পরিচিত। দুর্ঘটনা হলে সিএনজির ক্ষতি হতো, কিন্তু সিএনজি অক্ষত রয়েছে। শুধু আমার স্বামীই মারা গেছে। এর আগের দিন রাতে কেউ একজন আমার স্বামীকে সাবধানে থাকার জন্য মোবাইলে জানিয়েছিল। ঘটনার দিন দুপুর বেলায় তারেক আমার স্বামীর অবস্থান জানতে চেয়েচিল। তারাই আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়েছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সদর থানার উপ-পরিদর্শক আবদুল মতিন বলেন, নিহতের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিপি/কেজে