ফারুক ওয়াহিদ
গামছা শুধু এক টুকরো গা মোছার কাপড় বললে ভুল হবে- গামছার সাথে জড়িয়ে আছে আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। গামছা নিয়ে কত গান, কত কবিতা, কত ছড়া লেখা হয়েছে আর কত স্মৃতি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার হিসেব কি আছে আমাদের কাছে?
গামছায় চোখ ধাঁধানো লাল, হলুদ, কমলা, নীল, খয়েরী এ ধরনের উজ্জ্বল মিশ্রন রঙ ব্যবহার করা হয় বলেই সকলের নজর কাড়ে- যদিও গামছার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রঙ উঠতেই থাকে- আমি বলবো গামছার যদি রঙ না উঠে তাহলেতো সেটা গামছাই না! গামছা যে রঙেরই হোক না কেন একটু হলেও লাল রঙ থাকবেই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গামছার বহুবিধ ব্যবহার করেছে। সাধারণ শ্রমিক, রিক্সাচালক, নৌকার মাঝি, ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে অফিসের বড় কর্মকর্তা এবং প্রবাসীরাও গামছার ব্যবহার এখনো করে থাকেন অর্থাৎ গামছা না হলে যে চলেই না। নৌকা বাইস-এ দেখা যায় নৌকা চালকদের মাথায় বাহারি রঙের গামছা মাথায় বাঁধা আর গামছার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলার মহিলারাই বা কম কিসে? স্নান শেষে মহিলারা ঘনকালো মেঘবরণ দীর্ঘ এলোকেশকে গামছা দিয়ে ঝেঁড়ে খোপায় গামছা বেঁধে প্রকৃতির নিয়মে হেয়ার ড্রায়ার-এর কাজ সেরে থাকেন যা বিশ্বে বিরল ঘটনা। যদিও ইদানীং তোয়ালে ব্যবহার শুরু হয়েছে কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মিটে?
বাংলার গামছা এখন ফ্যাশনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফ্যাশান ডিজাইনার বিবি রাসেল-এর হাতের ছোঁয়ায় তাঁতিদের হাতে বোনা গামছা দেশে-বিদেশে ফ্যাশন জগতে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসগুলোতে ফেব্রিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গামছা। শাড়ি, স্কার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ, টপ, জ্যাকেট, ধুতি, প্যান্ট, ব্লাউজ, ওড়না ইত্যাদি-তে লাল, উজ্জ্বল লাল, হলুদ, কমলা, নীল, খয়েরী, সবুজ, গাঢ় সবুজ এ ধরনের মন কেড়ে নেওয়া রংবেরং-এর খাঁটি গামছা ব্যবহৃত হচ্ছে- যেটার পথিকৃৎ ফ্যাশান ডিজাইনার বিবি রাসেল।
গানের শিল্পীরাও আজকাল গামছার প্রচলন শুরু করেছেন- মঞ্চে এসে দর্শকশ্রোতার কাছে এসে গলায় গামছা ঝুলিয়ে অথবা মাথায় গামছা না বাঁধলে যে গলায় গানই উঠতে চায় না। রাজনীতিবিদরাই বা কম কিসে? গ্রাম-বাংলা এমনকি শহরে সকল স্তরে গামছার জনপ্রিয়তা বা প্রচলন দেখে এবং জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে গামছাকেই এখন তারা গলায় ঝুলিয়েছেন। পাকিস্তানি আমলে স্বৈরাচারী সরকারের উদ্দেশ্যে মাওলানা ভাসানির বিখ্যাত উক্তি, “গলায় গামছা লাগিয়ে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবো” বাংলার মানুষ এখনো ভুলেনি।
এইতো কিছুদিন আগে একটি ছাত্রসংগঠনের নেতার জন্মদিন উপলক্ষে দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই নেতা নিজেই রিক্সাচালকদের গামছা বিলি করতে এবং সেই গামছা দিয়ে রিক্সাচালকের গাম মুছে দিচ্ছেন- চমৎকার চিন্তাভাবনা ও প্রশংসনীয় উদ্দ্যোগ। ছাত্ররাজনীতি করতে হলে কতদিকে চিন্তাভাবনা করতে হয় ছাত্রনেতা ঠিকই বুঝেছেন গামছার জনপ্রিয়তা এবং রিক্সাচালকদের এই গামছা কত প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায়ও গামছার কথা চলে এসেছে- “তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে/গামছায় জল ভরি গায়ে তার ঢালে।”
কবি জসীমউদদীন আমার বাড়ি কবিতায় লিখেছেন- “শালি ধানের চিঁড়ে দেব/ বিন্নি ধানের খই/ বাড়ির গাছের কবরী কলা/ গামছা বাঁধা দই।”
কিছুদিন আগে বিটিভি এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ড-এ ‘রূপান্তর’ নামক একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিক জনাব মো. শহিদুল হোসেইন সরকার গ্রাম বাংলার গামছার উপর একটি চমৎকার প্রতিবেদন তৈরি করে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বিশেষ করে রূপসদী গ্রামের তাঁত শিল্প এবং তাঁত শিল্পের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র উপহার দিয়েছেন- অনুষ্ঠানটি আমি দেখেছি, প্রতিবেদনটিতে রূপসদী গ্রাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে আমার শরীর শিহরিত এবং রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে! এই রুপসদী হলো আমার দ্বিতীয় আবাস ভূমি- একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই রূপসদী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প রূপসদী জমিদার বাড়িতে আমি থেকেছি, খেয়েছি এবং এখান থেকেই যুদ্ধের বিভিন্ন আপারেশনে যেতাম- তাই আমার জীবনের সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহূর্তগুলো কেটেছে এই রূপসদীতে- জনাব মো. শহিদুল হোসেইন সরকারকে অনেক ধন্যবাদ- তিনি গামছা শিল্প নিয়ে আলোচনা করাতে। গামছা নিয়ে স্মৃতির মনিকোঠায় অনেক সুখকর স্মৃতি জড়িয়ে আছে- স্বল্প পরিসরে এখানে সব বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে গামছা নিয়ে একটু আলোকপাত করি:
১৯৭১-এর ৩১ মার্চ আমরা পরিবারের সবাই পায়ে হেঁটে ঢাকা ছেড়ে রামপুড়া-বাড্ডা বালুনদী এবং শীতলক্ষা নদী পার হয়ে ভুলতা-নরসিংদী রোড হয়ে বাঞ্ছারামপুর চলে আসি- আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল সাথে শুধু পড়ার কাপড় এবং অতিরিক্ত সামান্য কিছু কাপড়চোপড় নেওয়া যাবে আর কিছুই না- কিন্তু আর কিছু সাথে না আনলেও গামছা নিতে কিন্তু ভুল করি নাই।
১৯৭১-এর এপ্রিল মাস মুক্তিযুদ্ধে অর্থাৎ আগরতলা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। লুঙ্গি-গামছা কেনার জন্য বাঞ্ছারামপুর হাটে যাই- তিতাস-ডোলভাংগা নদীর তীরে বাঞ্ছারামপুর-এ তখন বিরাট জমজমাট হাট বসতো প্রতি রবিবার- এটাই আমার জীবনের প্রথম বাঞ্ছারামপুর হাট দেখা। বিরাট হাট বড় বড় বট গাছের নিচে গামছার হাট- নতুন কাপড়ের গন্ধ সাথে মারের মৌ মৌ গন্ধ ভালই লাগছে- গামছা আর গামছা যেদিকে তাকাই শুধু রংবেরং-এর চোখ ধাঁধানো গামছা- কোনটা নিয়ে কোনটা নেব মাথা ঘুড়িয়ে যায়। গামছার দোকানদার সব ছাত্র- স্কুল বন্ধ তাই মনে হয় সবাই বাবার ব্যবসাকে হেল্প করছে বা অনেকে নিজেই নতুন করে গামছার ব্যবসা শুরু করছে। আমার সাথে চাচাত ভাইসহ আরো অনেক ছেলেপেলে ছিল। আমি আবার সবসময় তিনটি গামছা একসাথে কিনি- সেটার আবার অন্যরকম ইতিহাস আছে সেটা পড়ে বলছি। একটা আকর্ষণীয় ডিজাইনের গামছা চোখে পড়ে- গামছা হাত দিয়ে ধরার সাথে সাথে দোকানদার ছেলেটি বলে উঠলো সারা বাঞ্ছারামপুর বাজার চ্যালেঞ্জ এই ডিজাইনের সরস গামছা কেউ দিতে পারবো না- কয়ডা নিবেন? আমি বললাম তিনডা গামছা নিমু- বলার সাথে সাথে ছেলেটি আমার হাত থেকে গামছাটি নিয়ে জোরে ঝারা দিল এবং ভাজ করে ফেললো এবং সাথে সাথে আরো দুইটি গামছা দিল অর্থাৎ তিনতিরিক্কে নয়টা গামছা ভাজ করলো- আমি বললাম তিনটা নিমুনা শুধু তিনটা নিমু- ছেলেটি বললো এক ছেও (একসাথে জোড়া দেওয়া তিনটা) নিবেন? আমি বললাম রং কেমন থাকবতো? ছেলেটি বললো রং গ্যারান্টি একটু কষও উঠবো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল আমি বললাম, তোমার গামছা আমি নিমু না- ছেলেটি বললো কি হইছে ছোট ভাই গামছা পছন্দ হয় নাই? বলি, গামছা পছন্দ হইছে ডিজাইনও খুব সুন্দর কিন্তু তারপরও নিমুনা, তুমিতো বললা তোমার গামছার রঙ একটু কষও উঠবো না- আমি বলি, দুরমিয়া গামছার যদি রঙই না উডে এইডাতো কোনো গামছাই না, জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত গামছার রঙ উঠতেই থাকবো সেইডাই হইলো সত্যিকারের আসল গামছা। ছেলেটি বললো, আচ্ছা ঠিকআছে আপনি একটু গামছার কোনাডা পানিত ভিজাইয়া দেখেন রঙ উডলেই নিয়েন। আমি বলি, ভিজান লাগবো না আমি গামছা নিমুনা তোমার কতাই বিশ্বাস করলাম। আমার কথা শুনে ছেলেটি মুর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। পাশের দোকানের আরেক ছেলে আমাক ডাকাডাকি শুরু করে- ভাই আমার কাছে আইয়েন ভালো গামছা আছে। সুন্দর আকর্ষণীয় ডিজাইন দেখে একটি গামছা পছন্দ করি, এখানে একটি বলতে জোড়া লাগানো তিনটি গামছা। ছেলেটি গামছা ভাজ করতে থাকে- দাম ঠিকঠাক করে তারপর জিজ্ঞাসা করি, দাড়াও আসল কথাইতো জিজ্ঞাসা করলাম না গামছার রং থাকবোতো? দোকানদার ছেলেটি বলে বাঞ্ছারামপুর, ভৈরব, বাবুরহাটের গ্যারান্টি এইরকম গামছা কেউ দিতে পারবোনা। আমি বলি দুর মিয়া আমি জিগাই রঙের কথা আর তুমি ভৈরব, বাবুরহাটের কতা কী কও এইসব? ছেলেটি বলে রঙ গ্যারান্টি এক ধোয়া দিলে তিতাস নদী লালে লাল হইয়া যাইবো গা। আমি বলি এই গামছাইতো আমি এতোক্ষণ ধইরা থুঁজতাছি, আমার পছন্দ হইছে এই গামছাই আমি নিমু। চাচাতো ভাই ফিরোজ ভাই বলে ফারুক, জাইনন্যা শুইনন্যা তুমি রঙ উঠা গামছা নিবা- আমি বলি আপনারা বাঞ্ছারামপুরের মানুষ গামছা চিনেন না এইডাই হইলো আসল গামছা। পাশের দোকানের ছেলেগুলো এই দোকানের ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে, তুই ব্যবসা করতে পারবি রে- চল্ আমরা বাইত(বাড়ি) জাইগা। একাত্তরে বাঞ্ছারামপুর হাট থেকে গামছা কেনার স্মৃতি আবারো মনে পড়ে গেলো।
আমি প্রথমেই বলেছি, গামছা যে রঙেরই হোক না কেন একটু হলেও লাল রঙ থাকবেই- কথাটা আমি এমনি এমনি বলি নাই- গামছার এই রক্তিম বর্ণের সাথে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নিজের তাজা রক্ত মিলে মিসে একাকার হয়ে গেছে বার বার। একাত্তরের ১ অক্টোবর নবীনগরের মুক্তিযোদ্ধারা মারাত্মক আহত অবস্থায় আমাকে এবং সহযোদ্ধা মিজান নামে দুইজনকে পানি থেকে প্রায় অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কাইতলা নামক গ্রামে/বাজারে নিয়ে যায় এবং হাঁটুর ক্ষতস্থানে রক্ত বন্ধ করার জন্য লাল গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়- তখন তাজা রক্ত এবং গামছার লালরঙ একাকার হয়ে যায়। রূপসদী জমিদার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গামছা বিছিয়ে পাকা ফ্লোরে ঘুমাইতাম নিচে খড় বিছানো থাকলেও এই গামছাই ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতো যদিও খড়ের জন্য শরীর কুটকুট করতো। সহযোদ্ধা অনেকেই মাথায় গামছা বেঁধে রাখতো- আমি সবসময় কোমরে শক্ত করে বেঁধে রাখতাম একদিকে শরীরে জোর পাওয়া যেতো আর অন্য দিকে লুঙিতে ভালোভাবে গিঠ্ঠু দিতে পারতামনা তাই কোমরে গামছা বেঁধে রাখলে লুঙির উপকার হতো। টহল দেওয়ার সময় তিতাস নদীতে এই গামছা পড়েই গোছল করতাম। খাওয়ার সময় গামছা বিছিয়ে নিতাম সেটা ক্যাম্পে হোক বা বাইরে হোক। যাদের রাইফেলের বেল্ট ছিল না তারা গামছাকে বেল্ট হিসেবে ব্যবহার করতো। একবার তিতাস নদী গোদারা(খেয়া নৌকা)দিয়ে পারি দেব জায়গাটি ছিল বাঞ্ছারামপুরের কমলপুর-ঝগড়ারচর গোদারাঘাট- নদীতে ভাটা ছিল তাই বড় নৌকা তীরে ভিড়তে পারছেনা তাই কাঁদাপানিতে নামতে হবে- সবাই দেখছি নৌকা থেকে লাফ দিয়ে শুকনা জায়গায় নামছে- আমিও দেখাদেখি দিলাম লাফ শুকনো জায়গাতে যেতে পারলামনা কাঁদা পানিতে পড়ে যাই সাথে ছিল রাইফেল এবং গুলি বোঝাই একটি জলপাই রঙের স্টিলের বক্স- স্টিলের বক্সের কোনা লেগে হাঁটুর উপরে অনেক অংশ কেটে যায় এবং সাদা মাংস বেরিয়ে পড়ে এবং মুহূর্তেই রক্ত বের হচ্ছে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। খেয়াঘাটে বসে থাকা একবৃদ্ধ দুর্বাঘাস হাত দিয়ে ডলে আমার ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয় এবং তাঁর কাঁদে থাকা গামছা দিয়ে টাইট করে বেঁধে দেন- বিদায়ের সময় বলি চাচা আপনার গামছা? লোকটি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, বাবারা তোমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করতাছো আর এই একটা গামছার চিন্তা করতাতো? বৃদ্ধের আন্তরিকতা দেখে চোখে পানি চলে আসে, বৃদ্ধের গামছাটি প্রায় নতুন ছিল এবং লাল রঙতো অবশ্যই ছিল- দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। সবই মনে আছে আয়নার মতো ভেসে উঠছে সব। যুদ্ধের সময় ব্যাংকারে গামছা বিছিয়ে নিতাম। তখন রাইফেল বা হাতিয়ারটি আমাদের কাছে কত প্রিয় ছিল সেটা বুঝানো যাবে না- সেই প্রাণপ্রিয় রাইফেলটি গামছা দিয়ে সবসময় মুছে পরিস্কার করে রাখতাম- মুক্তিযুদ্ধের সময় গামছার যে কত প্রয়োজন ছিল এবং কত রকম কাজে ব্যবহার করা হতো সেটা বলে শেষ করা যাবে না। ভারতে আসামের লোহার বন ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং-এর সময় কোমরে সবসময় গামছা বাঁধা থাকতো। গামছা পড়ে পাহাড়ি ঝরনাতে গোছল করতাম। জোকে ধরলে বা কামড় দিলে এই গামছা দিয়েই রক্ত মুছতাম বা বেঁধে রাখতাম রক্ত বন্ধের জন্য।
ঢাকায় নিউমার্কেট বা কাওরান বাজার থেকে গামছা কিনে আসলে আব্বা সবসময় বলতেন দোকানদার ঠকাইছে তোরে- ভালো গামছাটা রাইখা তোরে নিরস গামছাটা দিছে- এরপর থেকে আমি একসাথে জোড়া লাগানো তিনটা গামছা কিনি যেন আব্বা বলতে না পারে ঠকাইছে- তারপরও বলতেন দামের দিক দিয়া ঠকাইছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজী মুহম্মদ মহসিন হলের অনাবাসিক ছাত্র ছিলাম তাই বিভিন্ন কাজে ঘনঘন মহসিন হলে যেতে হতো- বন্ধুর রুমেতো বটেই বারান্দায় শুকাতে দেওয়া নানান বাহারি রঙের গামছার ছড়াছড়ি দেখতাম, ছাত্রটি যে জেলা/উপজেলা/থানার বাসিন্দাই হোকনা কেন? সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের চোখ ধাঁধানো রঙের গামছা থাকবেই বেশির ভাগ গামছাই যার যার নিজ এলাকা বা বাড়ি থেকেই নিয়ে আসতো তারা। এখন ঢাবির আবাসিক হলে গামছা থাকে কিনা আমি বলতে পারবো না- এখনতো আবার তোয়ালের ছড়াছড়ি, তারপরও গামছার বিকল্প গামছাই।
সেন্টাল মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম প্রায় তিন মাস- এখন যেটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগ পুরোটাই ছিল মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল। আমার ওয়ার্ডটি ছিল অনেক বড় ওয়ার্ড কারো হাতে ব্যান্ডিস, কারো পায়ে, কারো মাথায়, আমার ছিল পায়ে ব্যান্ডিস সবাই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। সাথে আর যাই কিছু থাকুকনা কেন প্রত্যেকের অন্ততপক্ষে একটি করে গামছা ঠিকই ছিল। আমিও বাসা থেকে গামছা আনতে বলি, আম্মা আমার জন্য একটি নতুন গামছা নিয়ে আসেন সেটাও ছিল লাল রঙের। বকসীবাজার বদরুননিসা কলেজের ছাত্রীরা কলেজ খোলার দিন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন আসতেন আমাদের সেন্টাল মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে- তারা আমাদেরকে মাথা ধুইয়ে দিতেন, গামছা দিয়ে মাথা মুছে দিতেন, ডেটল মিশানো পানিতে গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দিতেন এবং দুপুরের খাওয়া খাইয়ে দিতেন। ছাত্রীরা আমাদের জন্য নাবিস্কো টফি নিয়ে আসতেন এবং ম্যাগাজিন, পত্রিকা এবং বিভিন্ন সংকলন সাথে নিয়ে আসতেন। বদরুননিসা কলেজের ছাত্রীদের গামছা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশূষার কথা অর্থাৎ এই অধ্যায়টুকু দেশবাসীর কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
কবি জসীম উদদীন রচিত গ্রামবাংলার জনপ্রিয় একটি ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় ভালোবাসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক বা স্মৃতি গামছার কথা উল্লেখ করেছেন যা বাংলার মানুষের মনে এমনভাবে দাগ কেটেছে শুনলে চোখ ভেজে আসে যা কোনদিন ভুলার নয়-
https://youtu.be/7cia-477AY8
“যদি বন্ধু যাবার চাও
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে
বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে।।”
[ফারুক ওয়াহিদ: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া]