হাফিজুর রহমান হাবিব , তেঁতুলিয়া(পঞ্চগড়) প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার এক প্রত্যন্ড অঞ্চলে গর্ভবতী মায়েদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন মোছা. মেহেরুন নেহার লিলি নামে এক সিএইচসিপি। গত আট বছরে সাত শতাধিক প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি করেছেন তিনি। তার এ কাজে এ অঞ্চলে ক্লিনিকটিতে স্বাভাবিক সস্তান প্রসবে আস্থা বেড়েছে বহুগুণে। লিলি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কাজিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি। সরেজমিন ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, স্বাস্থ্যকর্মী লিলি বিভিন্ন রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন।
শিশুদের নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন অনেক মায়েরা। গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শ দিচ্ছেন। যাদের ওষুধ প্রয়োজন, তাদের ওষুধপত্র দিচ্ছেন। চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতি নিশি বেগম, সাস্তনা আক্তার বৃষ্টিসহ কয়েকজন জানান, তাদেরকে নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন মেহেরুন নেহার লিলি। কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি, খরচও হয়নি তেমন একটা। মা-শিশু সবাই ভালো আছেন তারা।
১৯৯৮ সালে ওই উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে কাজিপাড়া গ্রামে এই ক্লিনিকটি স্থাপিতহয়। জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় ব্যক্তি রমিনা খাতুন। এ ক্লিনিকটি থেকে তেঁতুলিয়া উপজেলাস্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ২০ কি.মি. ও জেলা আধুনিক সদর হাসপাতাল ৩৫ কি.মি.। গর্ভবতী মায়েদের প্রসব ব্যথা উঠলেই ছুটে আসেন কাছের মানুষ মেহেরুন নেহার লিলির কাছে। হাতের
নাগালে নরমাল ডেলিভারি করে বেঁচে যাচ্ছে আর্থিক খরচ, তেমনি দোরগোড়ায়চিকিৎসাসেবা পাওয়ায় কষ্ট করে যেতে হচ্ছে না শহরের হাসপাতালগুলোতে।
২০১১ সালে মেহেরুন নেহার লিলি কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডর সিএইচসিপি)হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। যোগদানের পর তেঁতুলিয়া হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরুকরেন প্রাথমিক চিকিৎসা। ২০১৪ সালে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেন্ডেন্ট (সিএসবিএ) বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৫ সালে স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শুরু করেন নরমাল ডেলিভারি কার্যক্রম। বুকে দুরু দুরু ভয় নিয়ে প্রথম ডেলিভারির কাজটি করেছিলেন। মাত্র এক ঘণ্টার চেষ্টায় সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের পর থেকেই ভয় ভাঙে তার। ধীরে ধীরে মানুষকে সাহায্য করার এ কাজটিতে আনন্দ পেতে শুরু করেন। আট বছরে প্রায় ৭০০ নরমাল ডেলিভারি করে হয়ে উঠেছেন
আস্থার প্রতীক ।
এ কারণে ক্লিনিকটি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ক্লিনিক হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছে। স্বাস্থ্যকর্মী লিলি বলেন, ‘প্রথম প্রথম আমার খুবই ভয় লাগত। ভাবতাম আমার দ্বারা এ জটিল কাজ কীভাবে সম্ভব হবে। ফরিদা আক্তার নামের এক নারীর প্রথম ডেলিভারি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমার সাহস বেড়ে যায়। কনকনে শীতে অথবা বৃষ্টিতে ভিজে, সারারাত পরিশ্রম করে যখন একটি গর্ভবতী মায়ের গর্ভ থেকে ফুটফুটে সুস্থ সন্তান দুনিয়াতে আসত তখন ভুলে যেতাম সব কষ্ট। ডেলিভারি করতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়। আমার কাছের আত্মীয় অনেকের ডেলিভারি করেছি, যেটা আমার ভালো লাগা ও প্রাপ্তি। আমার এ অসাধ্য কাজে সার্বিক পরামর্শসহ সাহস জুগিয়েছেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. পীতাম্বর রায়, এইচ আই শরীফ উদ্দিন, এএইচআই জমির উদ্দিন, এইচএ দেলোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই।’
লিলি আরও বলেন, ‘এখানকার হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যারা সিজার করাতে পারেন না, তারা খুব সহজে নরমাল ডেলিভারি করাতে আমার কাছে আস্থা নিয়ে আসছেন। এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিটি মা ও শিশু সুস্থ রয়েছেন। এখন রাত-দিনে সমস্যা হলেই ডাক পড়ে। রোগীরা সরাসরি কিংবা মুঠোফোনে সমস্যার কথা বলছেন। তাদের সেবা করতে পেরে ভালো লাগে।’ নরমাল ডেলিভারির কাজে সন্তুষ্ট গৃহবধূ আল্পনা বেগম বলেন, ‘লিলি আপা ভালো মানুষ। যখনই তাকে ফোন দিই তখনই পাওয়া যায়। নরমাল ডেলিভারিতে তাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। খুব সুন্দরভাবে অল্প সময়েই আমার ডেলিভারি সম্পন্ন করেছেন। তার কাজে আমিসহ সবাই সন্তুষ্ট।’
স্থানীয় আলহাজ শেখ কামাল বলেন, ‘স্বাস্থ্যকর্মী লিলির মাধ্যমে সঠিক সেবা পাচ্ছে এ এলাকার মানুষ। আমাদের বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ আসছে চিকিৎসাসেবা নিতে। ভালোভাবে নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে। এখন সাত শতাধিক নরমাল ডেলিভারি করেছেন স্বাস্থ্যকর্মী। এখন পর্যন্ত খারাপ রিপোর্ট আসেনি।’ ক্লিনিকটি যদি আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। একই কথা বলেন ইউপি সদস্য ও ক্লিনিক গ্রুপের সভাপতি রাইতু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘নরমাল ডেলিভারিতে অত্র উপজেলার একটি ভালো রেকর্ড অর্জন করেছে আমাদের কাজিপাড়া ক্লিনিকটি। স্থানীয়দের দাবি এই ক্লিনিকটি আরও উন্নতমানের করা হলে সুবিধা পাবে হাজার হাজার জনগোষ্ঠী। তবে
ক্লিনিকটি স্থাপিত পর থেকে কোনো ধরনের সংস্কার করা হয়নি।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিকে সাত শতাধিক নরমাল ডেলিভারি, সেটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। উত্তরাঞ্চলে এরকম রেকর্ড খুবই কম। সিএইচসিপি মেহেরুন নেহার লিলির এমন রেকর্ড প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। তাকে বিশেষ ধন্যবাদ
বিপি/কেজে