-আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ।।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা কথা নতুন এসেছে ‘ভারসাম্যের রাজনীতি’। আমদানি করেছেন বিকল্পধারার নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ইউরোপের রাজনীতিতে কথাটা নতুন নয়। গত শতকে ফ্রান্সে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যখন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত ছিল, তখন এই ‘ভারসাম্যের রাজনীতির’ কথাটা শোনা গিয়েছিল। ফ্রান্সে তখন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা তিনশ’র মতো দাঁড়িয়েছিল। এমনকি পুস্তক প্রকাশকরাও একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল।
ফল দাঁড়িয়েছিল সংসদীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলে। নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না। কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হতো। অন্তর্দ্বন্দ্বে এই কোয়ালিশন বেশিদিন টিকত না। এমন ঘটনাও ঘটেছে, একদিনে দু’বার সরকার গঠন এবং কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই সরকারেরই পতন ঘটেছে। ফ্রান্সে যে ভারসাম্যের রাজনীতির স্লোগান উঠেছিল, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ায় ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়।
ফ্রান্স নাৎসি দখল থেকে মুক্ত হওয়ার পর লিবারেশন আর্মির নেতা জেনারেল দ্য গলে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন। এক্ষণে দেশের এই দুরবস্থা দেখে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসেন। তিনি ফ্রান্সের সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করেন। প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং গণভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দেশের শাসনব্যবস্থা শক্ত হাতে ধরেন। ফ্রান্স রক্ষা পায়।
এ ধরনের উদাহরণ অনেক আছে। কোনো দেশের রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা দূর করার কাজে ভারসাম্যের রাজনীতি অনুসরণ বা কোয়ালিশন সরকার গঠন যে সুফল দেয়নি, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোয়ালিশন সরকার এত বেশি অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যস্ত থাকে যে, দেশের উন্নয়নে তারা প্রকৃত কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এটা আমরা দেখেছি ব্রিটেনে ক্যামেরন-নিক ক্লিগের কোয়ালিশন সরকারের সময়। টোরি ও লিবারেল দুটি বিপরীত আদর্শের দল। কিন্তু ঠেকায় পড়ে অর্থাৎ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে টোরি দল লিবারেলদের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছিল।
পরিণতিতে কোয়ালিশনের দুই শরিকে ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। পরবর্তী নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে টোরি দল হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। ভারতে বিজেপির অটল বিহারির সরকার জোটনির্ভর হওয়াতে হিন্দুত্ববাদ প্রচারে তেমন জোরেশোরে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘গেরুয়া ভারত’ গঠনে কোনো বাধারই সম্মুখীন হচ্ছেন না।
বাংলাদেশেও ঐকমত্যের সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যতটা জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি, বর্তমানে তার চেয়ে অনেক বেশি জোরালো ভূমিকা রাখছেন। ইতিহাসও বলে, গণতান্ত্রিক সরকারেও প্রধানমন্ত্রী যদি অধিক প্রভাবশালী ও ব্যক্তিত্বশালী না হন, তাহলে তিনি নিজের ইচ্ছাতে সব সময় দেশের কল্যাণে এগিয়ে যেতে পারেন না। শেখ হাসিনার পক্ষেও প্রভাবশালী না হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডদান সহজ হতো না।
সাম্প্রতিক বিশ্বেও দেখা যায়, দুর্বল গণতন্ত্র দ্বারা কোনো দেশের উপকার হয় না, হয় সবল গণতন্ত্র দ্বারা। যে গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিত্বশালী ও প্রভাবশালী, তাকেই সবল গণতন্ত্র বলা হয়। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার, ভারতে নেহেরু ও ইন্দিরা, সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান, মালয়েশিয়ায় মাহাথির অত্যন্ত শক্তিধর, ব্যক্তিত্বশালী নেতা হিসেবে পরিচিত। তাদের দ্বারা দেশ এবং গণতন্ত্র দুই-ই উপকৃত হয়েছে। অন্যদিকে দুর্বল নেতৃত্ব দেশের উপকার করা দূরের কথা, গণতন্ত্রকেও ধরে রাখতে পারে না।
একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশে বিচারপতি সাত্তার ছিলেন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বিএনপিদলীয় রাষ্ট্রপতি। তিনি এমনই দুর্বলচিত্ত নেতা ছিলেন যে, তার দলের মন্ত্রীরাই তাকে বিভিন্ন ইস্যুতে ধমকাতেন। তার সেনাপতি জেনারেল এরশাদের এক ধমকেই তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন। নিজের মন্ত্রীদের তিনি দুর্নীতিবাজ আখ্যা দেন। অন্যদিকে আলেন্দে, ইন্দিরা, মুজিব- এসব নেতা বন্দুকের মুখেও আত্মসমর্পণ করেননি। প্রাণ দিয়েছেন, পিছু হটেননি।
বাংলাদেশের দিকে তাকালেও আমরা কী দেখি? সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী শাসন- কোনো কিছুর দ্বারাই তো দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা যায়নি। অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘোচানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। তার ঘোড়াটিও গণতন্ত্রের সুস্থ ঘোড়া নয়। নানা আঘাতে, ষড়যন্ত্রে খোঁড়া ঘোড়া। এই খোঁড়া ঘোড়াতে চড়েই তিনি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন। অর্থনীতির অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। অতীতের সামরিক ও সাম্প্রদায়িক স্বৈরশাসনের সব পুঞ্জীভূত জঞ্জাল এবং দুর্নীতি ও অপশাসনের কবল থেকে তিনি রাতারাতি দেশকে মুক্ত করতে পেরেছেন, তা নয়। তবে দেশটাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি আরও এক দফা ক্ষমতায় থাকতে পারলে দুর্নীতি, অনাচার এবং ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধেও যে তিনি কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে যদি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সুশাসনের সরকার বা ডা. বদরুদ্দোজার নেতৃত্বে ভারসাম্যের সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা অনেকেই এখন কল্পনাও করতে পারবেন না। আফগানিস্তানের কারজাই সরকার ছিল এর প্রকৃষ্ট উদহারণ। এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে কয়েক ডিভিশন মার্কিন সৈন্য কাবুলে রাখতে হয়। যতদূর মনে পড়ে, এই সরকারকে জাতিসংঘের (আমেরিকার) হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়ার জন্য ড. কামাল হোসেন একবার কাবুলে গিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে এখন সেই সুশাসনের অবস্থা কী? আফগানিস্তানে চলছে চরম অরাজকতা। এ সপ্তাহেও সন্ত্রাসীদের হাতে ৫০-এর অধিক নিরীহ আফগানকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জোট গঠনের আপত্তি সম্ভবত নেই। যদি তার দাবি মানা হয়, যতদূর মনে পড়ে প্রথম তিনি দাবি তুলেছিলেন, জোটের প্রধান দল সংসদের ১৫০ আসন নিজেরা রেখে বাকি ১৫০ আসন শরিক দলগুলোকে ছেড়ে দেবে। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠনের ব্যাপারে তিনি বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ বলছে মিত্রদের জন্য ১০০টি আসনের অফার তারা করে ফেলেছে। ভারসাম্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা তাদের বলেছিলাম, আপনারা ১৭৫টি আসন নেন। ১২৫টি আসন ছেড়ে দেন সব মিত্র দলের জন্য। আমরা বিকল্পধারা কখনও বলিনি অর্ধেক আসন দেন।’ অর্থাৎ বিকল্পধারার আগের অর্ধেক আসনের দাবিটা তাহলে খারিজ হয়ে গেল।
দেশের এই ভারসাম্যের রাজনীতি একটা চমৎকার ছবি ফুটিয়ে তুলছে। অর্থাৎ এই রাজনীতি নীতি ও আদর্শের নয়; এই রাজনীতি ক্ষমতার ভাগাভাগির। বিএনপি ডা. চৌধুরীর ফর্মুলা মোতাবেক আসন ভাগাভাগিতে রাজি নয়। সেজন্য তিনি ওই জোটে যাবেন না; বরং যে আওয়ামী সরকারকে তিনি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকার বলে ক্ষমতা থেকে তাড়াতে চান, তার কথামতো সংসদীয় আসন বণ্টনে রাজি হলে তিনি সম্ভবত, তাদের জোটেও যেতে রাজি। আমি যদি তাদের মনোভাব সম্পর্কে ভুল বুঝে থাকি তাহলে ক্ষমা চাই।
অন্যদিকে যে ড. কামাল হোসেন, আওয়ামী লীগের সাবেক শীর্ষ নেতা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোষিত অনুসারী, তিনি গিয়ে জুটেছেন বিএনপি-জামায়াত শিবিরে। মুখে গণতন্ত্র ও সুশাসনের বুলি। আওয়ামী লীগ এদের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কে অবশ্যই সতর্ক থাকবে, তবে এদের শক্তিকে ভয় করার কিছু নেই। এক গ্রুপের সুশাসনের এবং অন্য গ্রুপের ভারসাম্যের রাজনীতির স্লোগানের আড়ালে রয়েছে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসতে না পারার হতাশা এবং শেষ জীবনে শেষবারের মতো ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র লোভ। এই লোভের কাছে নীতি, আদর্শের কোনো বালাই নেই।
সিলেটের পর চট্টগ্রামের জনসভায় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যা বলেছেন, তাতে কর্মসূচির নামে যা বলা হয়েছে, তা হুমকি ছাড়া কিছু নয়। শেখ হাসিনা হুমকির কাছে মাথানত করার মানুষ নন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, তিনি রাজনৈতিক হুমকি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবেন। তার কথা শুনে অতীতের একটা কথা মনে পড়ছে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু যখন তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন ফৌজি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দম্ভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্রের দ্বারা (by weapon) এর মোকাবেলা করব। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আন্দোলনের অস্ত্র (weapon of movement) দ্বারা আইয়ুবশাহীর মোকাবেলা করব।’ তিনি তাই করেছিলেন।
দীর্ঘকাল পর স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, তথাকথিত ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতি তিনি মোকাবেলা করবেন রাজনীতি দ্বারা। আমার বিশ্বাস, একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ফ্রন্টে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মাথা তুলেছে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐক্য দ্বারাই তিনি তার মোকাবেলা করতে পারবেন।
লন্ডন, ২৮ অক্টোবর, রোববার, ২০১৮