বাংলাপ্রেস ডেস্ক : এ পর্যন্ত ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া । হত্যা ও অস্ত্র মামলায় তাঁর ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকর ও অন্যান্য কারণে তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে করা হয় ৩২ বছর। সেটার মেয়াদ শেষ হয় গতকাল রোববার। ওই দিন দুপুর প্রায় ১২টার দিকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
মুক্ত হয়ে যা বললেন শাহজাহান: কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, তিনি অতীতে যত অপরাধ করেছেন, সে জন্য সাজা খেটেছেন। কারাবাস তাঁকে পরিশুদ্ধ করেছে। প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাঁর আবেগ কাজ করেছে। তবে এ কাজ কাউকে না কাউকে করতেই হতো। আজ রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগ শেষে মুক্ত হয়ে শাহজাহান ভূঁইয়া এসব কথা বলেন। কারামুক্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি কারাগারে প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
কারামুক্ত হওয়ার পর কোথায় যাবেন সে প্রসঙ্গে শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার একটিই চিন্তা কীভাবে ভালোভাবে চলব। আমার বাড়ি নেই, ঘর নেই। আমি এখন বের হয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি, যিনি একসময় আমার সঙ্গে জেলে থেকেছেন। আমি কী করে খাব জানি না। সরকারের কাছে দাবি, আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তিনি করেন, আমার থাকার ব্যবস্থা করেন।’
শাহজাহান বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে, আদর করেছে। আমি সেখানে (কারাগার) ভালো ছিলাম। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জল্লাদের কাজ দিয়েছিল। আমি সাহসী ছিলাম বলেই এ কাজ পেয়েছিলাম। কাজটি আমি না করলে কেউ না কেউ করতেন। এখন আমি চলে এসেছি, এ কাজ অন্যরা করবেন।’
কোনো স্বজন আছে কি না, তা জানতে চাইলে শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার একটা বোন আছে বলে জানি। একটা ভাগনেও আছে। তবে জেলে আসার পর তাঁদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। তবে দু–একবার ফোনে কথা হয়েছে।’
কারও ফাঁসি কার্যকর করতে খারাপ লেগেছে কি না, তা জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘প্রতিটি ফাঁসির আগেই আবেগ কাজ করেছে। এখানে তো আমার কিছু করার নেই। এ কাজ (ফাঁসি) কাউকে না কাউকে তো করতে হতো। এখন আমি চলে আসছি, অন্য কেউ করবে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আমাকে এ কাজ করতে হয়েছে।’
মুনীর, এরশাদ শিকদার ও বাংলা ভাইয়ের শেষ কথা: শাহজাহানের হাতে যাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন শারমিন রীমা হত্যার আসামি মুনীর , খুলনার আলোচিত খুনি এরশাদ শিকদার ও জেএমবি নেতা বাংলাভাইসহ আরো অনেকে । শাহজাহান বলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে এরশাদ শিকদার বলেছিলেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি, আর মুনীর একটি সিগারেট চেয়েছিলেন। জেএমবি নেতা বাংলাভাই বলেছিলেন তার মৃতদেহের ছবি যেন কেউ না তোলে।
গত ২১ বছরে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৬ খুনি, ৪ যুদ্ধাপরাধীসহ ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। শাহজাহান ভূঁইয়া যাঁদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন, তাঁদের মধ্যে আরও আছেন বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জেএমবির দুই জঙ্গি।
জল্লাদ শাহজাহানের পরিচয় : ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিন বোন এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মাতা সব মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন।
তিনি নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জানা গেছে, একবার তার গ্রামে নারী ঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে তাকে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন।
ওই ঘটনার পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তার উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে।
মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সাথে গোলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু। ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা।
কারা সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ বাংলাদেশের আলোচিত ২৬ জনকে জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন শাহজাহান।
জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, কারা রেকর্ড অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি ৬০ জনের ফাঁস দিয়েছেন। জেলার মাহবুবুলের তথ্যানুযায়ী, ৪২ বছরের সাজার মধ্যে প্রতি ফাঁসির জন্য দুই মাস কারা রেয়াত পেয়েছেন শাহজাহান। কারাবিধি অনুযায়ী, আচার-আচরণ এবং অন্যান্য কারণে সব মিলিয়ে ১০ বছর ৫ মাস রেয়াত পেয়েছেন। সাজা খেটেছেন ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন। শাহজাহানের হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় যে ১০ হাজার টাকা তাঁর দণ্ড হয়েছিল, তা কারা কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিয়েছে।