বাংলাপ্রেস ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন অবশ্যই বাতিল করা উচিত। শুধু সাইবার নিরাপত্তা আইন নয়, পর্যায়ক্রমে সব কালো আইন বাতিল করা হবে। আমরা সাইবার আইনটি নিয়ে আরও মতামত নেব। প্রয়োজনে সাইবার সুরক্ষা দিতে নতুন আইন করা হবে। বিশেষ করে নারীদের সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কাজ করবে এটি। তিনি আরও বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ‘স্পিচ অফেন্স’ (মুক্তমত প্রকাশ) সম্পর্কিত মামলাগুলো সরকার দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনিও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি পাবেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এর সংশোধন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় বক্তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি এসব কথা বলেন। আইন মন্ত্রণালয় এই সভার আয়োজন করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. আসিফ নজরুল।
মতবিনিময় সভায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বতনমূলক আইন হিসেবে পরিচিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার অংশীজনসহ আইনজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সাইবার নিরাপত্তার জন্য আইন করা হলেও অতীতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে। আইনটি বাতিল করা উচিত। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তির সাইবার সুরক্ষা এবং ধর্ম ও নারীর অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন আইন করা যেতে পারে।
সভায় বক্তারা আরও বলেন, বিতর্কের মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গত সরকার বাতিল করলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে আগের প্রায় সব কালাকানুনই বহাল রাখা হয়েছে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আইনের অপপ্রয়োগ হয়ছে এবং এখনও এর সুযোগ রয়েছে। বক্তারা জানান, ২০০৬ সালে প্রথম তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করা হয়। বিতর্কের মুখে ২০১৮ সালে এটিই হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে এই আইনের আওতায় মামলা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮১৮টি।
এসব বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘সব মামলা চাইলেই বাতিল করা যায় না। অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে- বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দায়ের হওয়া কারও মামলা বাতিল হচ্ছে, আবার কারও মামলা কেন বাতিল করা হচ্ছে না। কিন্তু এখানে সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটিও জানা দরকার। কারণ সব মামলার একই স্টেজে নেই। হয়ত কোনটির সাজা হয়েছে, আবার হয়ত কোনটির চার্জশিট হয়েছে। আদালতে বিচারাধীন আছে। তাই এসব বিষয়গুলো বিবেচনা করেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’
পরিবর্তন বা সংশোধনের মাঝের সময়টুকুতে কি করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন মানুষের কাছে অনাস্থার জায়গা থেকেই যাবে। তাই আইন সংশোধন বা নাম রাখাকে সমর্থন করা যায় না। আইনের পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু পরিবর্তন বা সংশোধনের মাঝের সময়টুকুতে এটিকে স্থগিত বা কি করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে করে এই আইনের আওতায় আর একটাও মামলা না হয়।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামও বাতিলের আহ্বান: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুরো আইন ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামও বাতিলের আহ্বান জানাই।’
প্যানেল আলোচনায় ভার্চুয়ালি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, সংশোধিত (প্রস্তাবিত) সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে মানহানি তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানাই। দণ্ডবিধি থেকেও এটি তুলে দেওয়া উচিত। এছাড়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার যে বিষয়গুলো রয়েছে সেসব বিষয়ে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়ার একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
আইন দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশে বাধা দেওয়া কাম্য নয়: ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সাইবার নিরাপত্তা আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা আরও নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। তদন্ত পর্যায় এমমনভাবে হওয়া উচিত যেটি জনগনের পক্ষে যাবে। তিনি আরও বলেন, যারা মামলা দায়ের করেন তারাও জানেন এই মামলায় আসামি বেকসুর খালাস পাবেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্যে থাকে শুরুতেই যে কয়দিন খাটানো (কারাবাস) যায়। এই সিস্টেম থেকে বের হতে হবে। আইন দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশে বাধা দেওয়া কাম্য নয়।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাজমুজ্জামান ভূঁইয়া, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মোস্তাফিুর রহমান খান, আইনজীবী শিশির মনির, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নোভা আহমেদ, ব্যারিস্টার আনিতা গাজী, ব্যারিস্টার প্রিয়া আহসান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম ভুক্তভোগী খাদিজাতুল কোবরা, দিদারুল আলম, রেজাউর রহমান প্রমুখ।
বিপি/টিআই