বদরূল ইমাম
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় বাংলাদেশের একমাত্র কয়লাখনি ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করে ২০০৫ সালে। কয়লাখনিটি বড়পুকুরিয়ায় অবস্থিত দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে কয়লার জোগান দিয়ে থাকে। বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লাখনি–সংলগ্ন হওয়ার কারণে দুটি সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রথমত, এখানে কয়লা পরিবহনের বাড়তি খরচ নেই এবং দ্বিতীয়ত, কয়লা পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দূষণ ঘটার আশঙ্কা নেই। সে হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান আদর্শ।
গত জুলাই মাসে এই কয়লাখনি থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা উধাও বা চুরি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। খনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই কয়লা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করে ১৯ জন খনি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্থানীয় পার্বতীপুর থানায় মামলা করা হয়। আবার একই সঙ্গে খনি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই কয়লার ঘাটতিকে চুরি নয়, বরং সিস্টেম লস হিসেবে দেখানোর যুক্তি আনতে দেখা যায়। খনি কর্তৃপক্ষের এই স্ববিরোধী অবস্থান বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন খনি প্রশাসনকে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কয়লা উধাও হওয়ার কারণ যা–ই হোক না কেন, কয়লা ইয়ার্ড শূন্য হয়ে যাওয়ার ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং তাতে উত্তরবঙ্গের বিদ্যুৎ সরবরাহে বিপর্যয় ঘটে।
কয়লাখনিটি প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকার পর আবার চালু হলে কয়লা সরবরাহের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও আবার চালু হয়। তবে চাহিদার তুলনায় কয়লার জোগান কম থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম মাত্রায় হয়ে থাকে। একটি বিষয় দৃশ্যমান হয় যে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। এই খনি ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে কয়লা জোগান দেওয়ার জন্য বর্তমানে বা নিকট ভবিষ্যতে দৃশ্যমান কোনো দ্বিতীয় দেশীয় উৎস নেই। আবার বড়পুকুরিয়া কয়লার মতো উন্নত মানের কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করে এটিকে চালানো বাস্তবসম্মত নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে আমদানি করা কয়লা পরিবহন করে বড়পুকুরিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়লার দাম পড়বে বর্তমানের খনিটির কয়লা মূল্যের দ্বিগুণের বেশি। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন জেগেছে যে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিটি কত দিন কয়লা সরবরাহ করতে পারবে। কয়লাখনিটির বর্তমান খনন চুক্তি ও কার্যক্রম ২০২১ সালে শেষ হবে। কিন্তু তারপর কী হবে? খনন কার্যক্রমকে আরও অধিক গভীরতায় নিয়ে যাওয়া যাবে কি? কিংবা বিকল্প পন্থা হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে খনি সম্প্রসারণের কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি? সে লক্ষ্যে খনি অবকাঠামো ২০২১ সাল নাগাদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? অন্যথায় কয়লার অভাবে আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে দীর্ঘতর বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটবে কি?
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিটি চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে স্থাপন করা হয়। চীনের সিএমসি কোম্পানি প্রায় পাঁচ বছরে নির্মাণকাজ শেষ করে ২০০৫ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। মূলত দুটি কারণে কয়লাখনিটি প্রাকৃতিকভাবে কিছুটা নাজুক প্রকৃতির। একটি হলো কয়লার ওপরে একটি পুরু পানিবাহী বালুর স্তর, যেটি থেকে প্রচুর পানি প্রায়ই খনির ভেতরে প্রবেশ করে ও কখনো–বা খনিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। দ্বিতীয়ত, কয়লার স্তরের বিরাট পুরুত্ব, যা কিনা এককভাবে কেটে নিয়ে আসা যায় না; বরং তা একাধিক তলে সমান্তরাল স্লাইসে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে কেটে নিয়ে আসতে হয়। বড়পুকুরিয়ায় ৩৬ মিটার পুরু স্তরটিতে তিন বা চারটি স্লাইস কাটার নকশা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে অনেকটা কয়লা মাটির নিচে থেকে যায়, কারণ দুটি স্লাইসের মধ্যবর্তী অংশে কয়লা উত্তোলন করা যায় না। এ রকম কয়লাখনির অপর উল্লেখ্য বিষয় হলো, ওপর থেকে নিচের দিকে স্লাইসগুলো খনন করার সময় খনি ক্রমাগত অধিকতর অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে বর্তমানে খননকৃত তৃতীয় স্লাইস কাটার পর তার নিচে অধিকতর গভীরতায় চতুর্থ স্লাইস কাটা যাবে কি না, তা অনিশ্চিত এবং কাটা সম্ভব হলেও তা কেবল আংশিকভাবে হতে পারে।
ভূগর্ভস্থ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কতটা কয়লা উত্তোলন করা যাবে? কয়লা উত্তোলনের জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি চীনের কোম্পানি সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন চুক্তি করে। এই কয়লাখনিতে মোট কয়লার মজুত প্রায় ৩০ কোটি টন, যা কিনা প্রায় ৬৫০ হেক্টর এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। এলাকাটিকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়, তথা উত্তর এলাকা (২৭০ হেক্টর), মধ্য এলাকা (৩০০ হেক্টর) ও দক্ষিণ এলাকা (৮০ হেক্টর)। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিটি কেবল মধ্য এলাকাতেই সীমাবদ্ধ, কারণ কয়লা খনন ও উৎপাদন করার জন্য কেবল এখানেই খনির অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। চীনা কোম্পানি পর্যায়ক্রমে কয়েকটি চুক্তির অধীনে ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে এখান থেকে মোট কয়লা উৎপাদন করেছে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ টন, যা কিনা বড়পুকুরিয়ায় মোট কয়লা মজুতের ৫ শতাংশের কম।
বর্তমানে চীনা কোম্পানিটির সঙ্গে সর্বশেষ একটি ৪ বছর মেয়াদি (২০১৭-২১) চুক্তির অধীনে তৃতীয় স্লাইস থেকে কয়লা উৎপাদন চালু রয়েছে। এই চুক্তির অধীনে কয়লা উত্তোলন ২০২১ সালে শেষ হওয়ার পর আরও নিচে চতুর্থ স্লাইস থেকে কয়লা উৎপাদন অনিশ্চিত কিংবা সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়। তাই ২০২১ সালের পর উত্তর ও দক্ষিণ এলাকা থেকে কয়লা উত্তোলনই কয়লা সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। বর্তমানে বড়পুকুরিয়ায় উত্তর ও দক্ষিণ এলাকায় কোনো খনি কার্যক্রম নেই বা কোনো বাস্তব খনন প্রকল্প দৃশ্যমান নয়।
সম্প্রতি একটি বিদেশি খনি পরামর্শক অস্ট্রেলিয়ার জন বয়েড কোম্পানি বড়পুকুরিয়ার উত্তর ও দক্ষিণ এলাকা থেকে ভূগর্ভস্থ উপায়ে কয়লা খনন ও উত্তোলনের সম্ভাব্যতা জরিপ শেষে তার রিপোর্ট পেশ করেছে। খনি পরামর্শক কোম্পানির মতে, দক্ষিণ এলাকা থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে ১০ বছরে মোট ১ কোটি টন (অর্থাৎ প্রতিবছরে ১০ লাখ টন) কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। আর উত্তর এলাকা থেকে ১০ বছরে মোট প্রায় ৫০ লাখ টন কয়লা অর্থাৎ বছরে প্রায় ৫ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। অর্থাৎ ১০ বছর পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ এলাকা দুটি থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বছরে মোট ১৫ লাখ টন কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব। বড়পুকুরিয়ায় খনিসংলগ্ন ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন কয়লার প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ২০২১ সালে বর্তমানে চলমান মধ্য এলাকায় কয়লা উৎপাদন শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী আরও ১০ বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ন্যূনতম কয়লা চাহিদা মেটানো যেতে পারে, যদি উত্তর ও দক্ষিণ এলাকা দুটি খননের আওতায় আনা হয়।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে উত্তর ও দক্ষিণ এলাকায় কয়লা খননপ্রক্রিয়া চালানোর কোনো প্রকল্প এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এই এলাকা দুটিতে কয়লা খনন শুরু করার জন্য খনির অবকাঠামো তৈরি করতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগবে। সুতরাং ২০২১ সালে এখান থেকে কয়লা সরবরাহ করতে হলে এ বছরই সেখানে খনন অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। সময় থাকতে কাজ শুরু না করলে বর্তমানের মতো কয়লা–সংকটের আবর্তে পড়ে আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গিয়ে উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট ঘটুক, তা কারও কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানির কার্যকর পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়।
বড়পুকুরিয়া ভূগর্ভস্থ কয়লাখনিটি মোট মজুত কয়লার কেবল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করতে পারবে বলে খনি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। একটি বিরাট অংশ কয়লা ভূগর্ভ থেকে আহরণ করা যাবে না, যদি তা উন্মুক্ত খননপদ্ধতি অবলম্বন করা না হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতি ও উর্বর সমতল অঞ্চলে উন্মুক্ত খননপদ্ধতি সামাজিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে বড় রকমের বিতর্ক রয়ে গেছে। এ নিয়ে অতীতে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনায় বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনকেও জড়িয়ে ফেলেছে। বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খননপদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন সম্ভব বটে, কিন্তু তার সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক উপাদানগুলোর স্বরূপ জটিল। সর্বোপরি ওই এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের এতে সম্মতি আছে কি না, তার ওপরই নির্ভর করবে সেখানে এ পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ