রাব্বী আহমেদ,মেহেরপুর: মেহেরপুরের ভাষা সংগ্রামী নজির হোসেন বিশ্বাস (৮৩) ও ইসমাইল হোসেন (৮০) আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রন্ত হয়ে বাকরুদ্ধ প্রায়। দু’জনেই বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। মেহেরপুরের সাত ভাষা সংগ্রামীর মধ্যে বেঁচে আছেন এ দু’জন। জীবনের শেষ সময়ে এসেও একুশে ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন থেকে দেয়া সংবর্ধণা ছাড়া পাননি ভাষা সৈনিকের প্রকৃত সম্মান। তারপরও তারা বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন দেখে যেতে চান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকা ধর্মঘট চলাকালে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি করা হয়। এ খবর পেয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে মেহেরপুরের ছাত্র-জনতা।
২২ ফেব্রুয়ারি আবুল কালামের সভাপতিত্বে কালাচাঁদ মেমোরিয়াল হলের সামনে এক সমাবেশ হয়। সমাবেশে সরকারের নীতি নির্ধারণের সমালোচনা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জোরালো বক্তব্য রাখা হয়। মুন্সী সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে মেহেরপুর উচ্চ ইংরেজি মডেল স্কুলের মুসলিম হোস্টেলের ছাত্ররা পোস্টারিং, পিকেটিং করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতন সহ কারাবরণ করতে হয় তাদের। ১৯৫৫ সালে মেহেরপুর উচ্চ ইংরেজি মডেল স্কুলের ছাত্ররা একুশ ফেব্রুয়ারি ক্লাস থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল নিয়ে শহরে বের হয়। শিক্ষকরা শত বাঁধা ও ভয় ভীতি দেখিয়েও ২১ উদযাপন বন্ধ করতে পারেনি। শিক্ষকদের আদেশ অমান্য করে একুশ পালনের অপরাধে ইসমাইল ও নজির হোসেন বিশ্বাস সহ সাত জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জামিনে মুক্তি পেলেও স্কুল কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের ফোর্স টিসি দেয়া হয়। সে সময় ইসমাইল হোসেন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। নজির হোসেন বিশ্বাস ছিলেন ৮ম শ্রেণির ছাত্র। নজির হোসেন বিশ্বাস সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামে পরিবারের সাথে বসবাস করছেন।
আজ তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ প্রায়। তিনি ভাষা আন্দোলনের অগ্রগামী সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে তার পিতাকে পাক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মেহেরপুর সরকারি কলেজের পিছন থেকে তার পিতার লাশ উদ্ধার করা হয়। এতকিছুর পরে ভাষা সৈনিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেয়েও তাদের একটাই শান্তনা বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইসমাইল হোসেন বর্তমানে মেহেরপুর শহরের টিএন্ডটি পাড়ায় বসবাস করছেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে তিনি আ’লীগে যোগদান করে জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কয়েকটি জাতীয় দিবস ছাড়া আর কখনও কেউ তাদের খোঁজ নেয়না। প্রকৃত মর্যাদা না পাওয়ায় মনকষ্টে ভোগেন সব সময়। এরপরও মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্তির আশা। মেহেরপুরের প্রবীন সাংবাদিক ও লেখক তোজাম্মেল আযম জানান- ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই আমরা বাঙালিরা বিশ্বে একটি ইতিহাস তৈরী করেছি। কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বার্ধক্যে যাওয়া দুই ভাষা সংগ্রামীকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন করা হয়নি ইতোমধ্যে মারা যাওয়া মেহেরপুরের পাঁচ ভাষা সংগ্রামীকেও।
বিপি/কেজে