— কৌশলী ইমা
‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ আদিকালের সেই ঘটনা আরতো খাটে না, এখন সবার মুখ ফোটে, কারো বুক ফাটে না। লজ্জাবতী নারী দেখে কে বলেছে সেই কথা, যুগের হাওয়া বদলে গেছে, নারীর মনে নাই ব্যথা’। নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে হবে। পুরুষতন্ত্রকে সমূলেই উৎপাটন করতে হবে।
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘সময় এখন নারীর: উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম জীবনধারা।’ প্রতিবছর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়ে আসছে এ দিবসটি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার রক্ষা, নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাই এবারের নারী দিবসের মূল লক্ষ্য।
নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধ করাসহ একই কাজে নিয়োজিত নারীদের পুরুষের সমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ও রাজনীতিতে নারী প্রতিনিধি বাড়ানোর দাবিতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ দপ্তরের সামনে কর্মসূচি পালন হবে আজ। নির্যাতিত নারীরা ‘মি টু’ লেখা ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে সমবেত হবেন সেখানে।
এ ছাড়া বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই হলো গ্রাম ও পল্লী এলাকায় বসবাস করা নারী, যারা বিভিন্ন উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।গ্রামীণ নারীর অধিকার রক্ষা ও তাদের কার্যক্রমও তুলে ধরা হবে। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসও বাণী দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে চারিপাশে নারীদের অবস্থারও একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে অনেক নারী তার বিয়ে বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারতেন না। সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারতেন না। অনেকেই পরিবার থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করলেও তাদের সে আয় স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি বেশি হলেও এখনও পুরুষের তুলনায় অনেক কম। ৮ মার্চ সারা বিশ্বে যখন নারী দিবস পালন করা হচ্ছে, অন্যদিকে হয়তো কোন নারী সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে পদক্ষেপে নিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার যারা বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রকল্প ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি কথা হচ্ছে সবাই মিলে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া নারীর অধিকার আদায়ে একজন নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপশি পরিবারেরও বেশ কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। নারীর নিজেরও কিছু দায়িত্ব থাকবে। স্বেচ্ছাচারী হয়ে পুরুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করবে তা নয়। সর্বোপরি কথা হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহনশীল হতে হবে।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও নারী দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে বাংলাদেশে এখনো এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে নারী উপেক্ষিত। সামাজিকভাবেও নারীর অবস্থান সেভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি, চেষ্টা চলছে। আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, এ দেশে ডাকসুর ভিপি ছিলেন একজন নারী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাঙালি নারী পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের একজন নারী আন্তর্জাতিক দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন বাংলাদেশের নারী। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসাবে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০১৬ সালের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭২। লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে নারী। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হারও উল্লেখযোগ্য। এর পরও নারী উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলেও বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যায়নি। দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ১৮ বছরের আগেই মা হয়ে যান। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু নারীকে অনেক ক্ষেত্রেই এখনো অবজ্ঞা করা হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। শহুরে কিংবা নাগরিক জীবন নয়, দেশের সর্বত্রই নারীর গুরুত্ব আজ স্বীকৃত। তুলনামূলক বিচার যদি করা যায়, দেখা যাবে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক বেড়েছে। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সূচকে, সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান, তার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে নারী। এত কিছুর পরও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বৈষম্য একেবারে দূর করা যায়নি।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। পুরুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে না পারলে নারীর নিগ্রহের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, নির্যাতন কমবে না। সিডও সনদের অনুমোদনকারী রাষ্ট্রগুলোর একটি বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী নারীর প্রতি বিদ্যমান সব ধরনের বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, রীতিনীতি, প্রথা ও চর্চা নিষিদ্ধকরণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদানকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের; কিন্তু বাস্তবে তা কি প্রতিপালিত হচ্ছে? দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের চিত্র কি ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে? সমাজে এখনো নারীকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। নারীকে উপেক্ষা নয়, তাদের যোগ্য সম্মান দিতে হবে পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইসলাম ধর্মই নারীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছে। এ ধর্মে নারীর অধিকারের কথা সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। আর এসব নির্দেশনা এসেছে সুস্পষ্টভাবে। এজন্য ধর্মের নামে নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নারীদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
নারীর উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী।পৃথিবীতে এ রকম আর কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় সংসদে অবদান রাখতে বঙ্গবন্ধু নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে গেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরকারের বিভিন্ন পদে নারীদের নিয়ে আসতে অনেক বাধার মুখে পড়েছিলাম। আমার দৃঢ়পদক্ষেপের ফলে আজ বিমান চালাচ্ছেন নারী। এছাড়া পুলিশের বড় বড় পদে এখন নারীরা। আগে কখনো সচিব পদে কোনো নারী ছিল না। আমার সরকারই সচিব পদে নারীদেরকে নিয়ে এসেছে। তবে নারী-পুরুষ সকলের চেষ্টায় আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। সেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে নারীদের কর্মসংস্থানের। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়ই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। তিনি বলেন, আমাদের কারও দিকে মুখাপেক্ষী হতে থাকলে চলবে না। নিজেদের এগিয়ে যেতে হবে। নিজের মর্যাদা নিজেকেই কর্মের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হবে। সরকার প্রধান, সংসদের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা সবাই নারী। বিশ্বের কোথাও এ ধরনের নজির নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই। সমাজের সবাইকে একসঙ্গে দেশকে উন্নত করতে হবে। ইসলাম ধর্মই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ইসলাম ধর্মে নারীর গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের ১০ শতাংশ কোটা বঙ্গবন্ধু চারু করে গেছেন। নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন। ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেই। উপজেলা পরিষদে নারীরা আসার প্রক্রিয়া করেছি। স্থানীয় সরকারের সবক্ষেত্রে নারীদের আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীতে নারীদের উপস্থিতি, জজকোর্টে নারী, নারী পাইলটসহ বাংলাদেশের জন্য সাঁতার ও ভারোত্তলনে দুই নারীর স্বর্ণ জয়ের কথা উল্লেখ করেন। অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমান সমান প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
নারী দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। নারী দিবসের শুরু ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সূঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। সেদিন আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী। কারাগারে নির্যাতিতও হন অনেকে। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় `নারী শ্রমিক ইউনিয়ন`।
১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই নারীর সমঅধিকার আদায় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করে।
কৌশলী ইমা: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমকালীন ও লোকগানের শিল্পী। পরিচালক-সঙ্গীত একাডেমি, কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র
১০ বছর আগে নারী দিবস নিয়ে আমার গাওয়া সেই গানটি শুনতে এখানে ক্লিক করুন: