— পরাগ সঞ্চিতা
আমার মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি মেয়েকে আমেরিকা শিখিয়েছে এমপাওয়ারমেন্ট (বাংলাটা কি হবে?); শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে, আমি নিজেকে এখানেই খুঁজে পেয়েছি। তারপরেও আমার জন্মভূমি তো আমার জন্মভূমিই, আমার শৈশব, কৈশোর, আর তারুণ্য । আর আমার আবাসভূমি এই আমেরিকা হলো আমার তারুণ্য, সাফল্য, প্রাপ্তি। তুলনা চলেনা দুটোর মধ্যে।
নিউ ইয়র্কে থাকাকালে কাজ, স্কুল, লাইব্রেরি সেরে মধ্য রাতে কত দিন সাবওয়ে করে প্রায় ৫ ব্লক হেটে ঘরে ফিরেছি, কোনো ভয় করেনি। কি নিশ্চিন্ত জীবন! ২০০২ সালের কথা, ক্যাথলিক চারিটিসে ৯টা-৫টা কাজের পরে ক্লান্ত চোখে পাক্কা ২ ঘন্টা ড্রাইভ করে ব্রুকলিন থেকে স্টোনি ব্রুকস ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির ক্লাস করতে যেতাম। একদিন ক্লাস শেষে লাইব্রেরির কাজ করে রাত ১২টার দিকে স্কুল থেকে ফিরছি। গাড়িতে যে গ্যাস শেষ হয়ে গেছে সে খেয়ালই নেই, হটাৎ করে ঘুটঘুটি অন্ধকারে হাই ওয়েতে গ্রান্ড সেন্ট্রাল পার্কওয়ের উপর আজগুবি এক শব্দ করে আমার পুরোনো ফোর্ড টরাস গাড়িটা গেলো বন্ধ হয়ে! কি করা যায়? ইমার্জেন্সি নম্বর ৯১১ এ কল করলাম, এক মিনিট যেতে না যেতেই পুলিশের গাড়ি হাজির! আমার গাড়িটা পুলিশ এর গাড়ির সাথে জুড়ে টেনে নিয়ে গেলো কাছেই এক গ্যাস স্টেশনে। ইয়ং ম্যান পুলিশ অফিসারকে বললাম “থ্যাংক ইউ অফিসার”, উত্তরে “নো প্রব্লেম, ইউ টেক কেয়ার” । নিজেকে প্রশ্ন করি, এত্তো রাতে ঢাকার রাস্তায় কোনো তিরিশ বছর বয়েসী মেয়ে কি এই নিরাপত্তাটুকু পাবে? ঢাকাতে থাকাকালে সন্ধ্যা হলেই বাসার সবাই চিন্তা শুরু করতো কখন ফিরবো? সেই কিশোরী বয়স থেকেই জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টা করে চলেছি টিজিং এর সব স্মৃতি ।
স্বদেশে ছিল ইপটিজিং, দুর্নীতি, অরাজকতা, আর প্রবাসে রয়েছে অযাচিত ঘাতকের শঙ্কা, রেসিজম বা বর্ণবাদ, স্বজনহীনতার হাহাকার। আজকাল বর্ণবাদ তো রোজকার অভিজ্ঞতা।
মনে পরে সিটি ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স এর স্টুডেন্ট থাকা কালে আমার আফ্রিকান আমেরিকান সহপাঠী কড়ির কথা। কড়ি বলত “তুমিতো নিজেকে পৃথিবীর কোনো একটা ভূখণ্ডের সাথে সংস্পৃত করতে পারো, তুমি জানো তুমি কোথা থেকে এসেছ। আর আমাকে দেখো – আফ্রিকার কোন না কোন দেশ থেকে আমার পূর্ব পুরুষকে ধরে এনেছিল দাস প্রথা টিকিয়ে রাখতে তাতো আমি জানিনা। ঘানা, নাকি কেনিয়া, অথবা সাউথ আফ্রিকা, নাকি সোমালিয়া? তুমিতো তোমার ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার, পোশাক, কত কিছু নিয়ে গর্ব করো; আর দ্যাখো আমার গায়ের রং ছাড়া আর কিছুই আফ্রিকান না। অল আই ক্যান সেএ ইস আই এম আমেরিকান”। গল্পচ্ছলে ও আরো বলতো “জানো আমেরিকার সংস্কৃতি কি? আইনই আমেরিকার সংস্কৃতি”। “কেমন করে? আমার এই প্রশ্নের জবাবে ওর ব্যাখ্যা ছিল, “প্রচন্ড গরমে সেন্ট্রাল পার্কে অর্ধ নগ্ন নারী পুরুষেরা যখন সূর্য স্নানে শুয়ে থাকে, তখন মেয়েরা উদ্ধাঙ্গ ঢেকে রাখে কেন বলতো? কারণ নিউ ইয়র্কের আইন হলো মেয়েরা সম্মুখভাগ খোলা রাখতে পারবে না, এই আইনটি না থাকলে দেখতে ওদের গায়ে কাপড়ই থাকতো না” । আরো বলতো “ট্রাফিক লাইট মেনে চলে কেন সবাই? দ্যাখোনা একদম ফাঁকা রাস্তাটায় কেউ তোমাকে দেখছেনা, অথচ তুমি ট্রাফিক লাইট মেনে চলছো, কেন বলতো? কারণ তো একটাই; ধরা পড়লে টিকেট খাবে, টাকা গচ্ছা যাবে, তারপর লাইসেন্স কেড়ে নেবে। তাই আইনই এদেশের সংস্কৃতি”। কড়ির কথাগুলো আমাকে এখনো ভাবায়। ও দুঃখ করে বলতো যখন ওয়েস্ট সাইড হাই ওয়ের পাশের অভিজাত এলাকাতে ওর মায়ের সাথে দেখা করে রাস্তা পার হয়ে নিজের গাড়ির দিকে হেটে যেত তখন প্রায়ই সাদা পথচারী কড়িকে গাড়ি চোর ভেবে দাঁড়িয়ে পড়তো, আর ওর গতি বিধি লক্ষ করতো। কড়ির অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়।
অথচ ওই সিটি কলেজেরই অধ্যক্ষ সাদা মানুষ, প্রফেসর হেলমরিশ মনে প্রাণে একেবারেই সাদা ছিলেননা। রেস রিলেশন’ ক্লাসে একদিন সাদা এক টুকরো কাগজ স্টুডেন্টদের দেখিয়ে বললেন “বলতো এই কাগজটির রং কি?” আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বললাম “সাদা”; উনি কাগজটা নিজের মুখের পাশে নিয়ে বললেন “আমি কি সাদা?” আমরা বললাম “নাতো”। সাদা প্রফেসর হেলমরিশ নিজেকে সাদা ভাবতেননা, অথচ বোস্টনে ছোট্ট এক আপ স্কেল শহর নর্থ এন্ডোভার এর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মিসেস বার্নার্ড আবভাবে মহা সাদা ছিলেন। নিউ ইয়র্কে কখনো নিজের গায়ের রং অনুভব করিনি, বড়ো শহরে কত্ত রকম মানুষ, কিন্তু নিউ ইয়র্ক থেকে যত উত্তর দিকে মুভ করছি ততোই সাদাদের অহমিকাও যেন বেড়েছে ।
নিউ ইয়র্ক থেকে বোস্টনে যাবার পরে সেই প্রথম বর্ণবাদের অভিজ্ঞতা হলো। ২০০৫ সালে অন্তঃসত্ত্বা আমি কাজ ছেড়ে ঘরে, আমার পাঁচ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে মহা বিদ্বান বানানোর ব্রতে লিপ্ত। মেয়েতো কিন্ডারগার্টেনে পড়ে, এ প্লাস পাচ্ছে সব কিছুতে, কিন্তু সবগুলো কোয়াটার শেষে ফাইনাল পরীক্ষাতে দেখি মেয়ে পেলো বি! তাজ্জব ব্যাপার! মেয়ের হোমরুম টিচার মিসেস বার্নার্ডকে ঘটনা কি জিজ্ঞাসা করলে ভদ্রমহিলা বলিষ্ট কন্ঠে উত্তর দিলেন “ ইওর ডটার ইস হ্যান্ডিক্যাফট” ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝালেন মেয়ে বাড়িতে অন্য ভাষায় কথা বলে, আর একারণেই ওর ইংলিশ শুদ্ধ না। আজ কুড়ি বছর পরে মনে হয় এই কথাগুলা যদি এখন কেউ বলতো, তবে আদালত পর্যন্ত নিতাম। কিন্তু তখন সেই মনোবল ছিল না। বিনয়ের আঁধার আমি চুপচাপ ঘরে ফিরে এলাম, আর মেয়েকে বললাম আর কক্ষনো আমার সাথে বাংলাতে কথা বলবিনা, আমি তোর সাথে বাংলা বললেও তুই বলবিনা। সেই যে মেয়ে আমার বাংলা বলা বাদ দিলো- আর ওর মুখে মিষ্টি করে বাংলা কথা শুনিনা। আরো পণ করেছিলাম জন্ম থেকেই অনাগত কন্যার একমাত্র ভাষা হবে ইংলিশ। যেন সে ইংরেজিতে কথা বলে, ইংরেজিতে চিন্তা করে, ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখে। আমার সেই সিধান্ত নিয়ে আমার বাবা-মা, আত্মীয় বন্ধুরা প্রশ্ন তুলেছেন, সেই গল্প অরে এক দিন করবো। আমার ছোট মেয়ের বয়স এখন ১৩, ইংরেজি তার একমাত্র ভাষা, স্কুলের জন্য স্প্যানিশ শিখছে, দাদি-নানীর কাছে শুনে আজকাল টুকটাক বাংলা বলে, বাংলা বোঝে, কিন্তু ও ইংরেজিতে কথা বলে, ইংরেজিতে চিন্তা করে, ইংরেজিতেই স্বপ্ন দেখে।
বছর খানেক আগে লেখক হাসান ফেরদৌস নিউ ইয়র্ক থেকে কানেক্টিকাটে এসেছিলেন এক একুশের অনুষ্ঠানে, সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন -” আমেরিকাতে আমাদের বাচ্চাদের আমরা বাংলা শেখ, বাংলা শেখ করে শোর-গোলে তুলি, কিন্তু কক্ষনো কি চিন্তা করে দেখেছি যে আমেরিকা ওদের মাতৃভূমি? ওরা তো কাজের ইন্টারভিউ বাংলাতে দেবে না”। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় মধ্য পন্থায় বিশ্বাসী। সাদা কালোর মাঝের ধূসর রং আমার বেশি চোখে পড়ে। মাঝে মাঝেই মনো কষ্টে ভুগি মেয়েটা আমার বাংলা জানলোনা, সত্যজিতের তোপশেকে চিনলোনা, রবি ঠাকুরের গল্প গুচ্ছ পড়লোনা, কাজী নজরুলের কবিতা থেকে বিদ্রোহের অনুপ্রেনরনা পেলোনা, নেতাজী সুভাষ বসু, মাওলানা ভাসানীর কথা জানলোনা, ওর অত্যন্ত গুণীজন প্রপিতামহ সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংগঠক মুহাম্মদ মোদাব্বেরের লেখাগুলো পড়লোনা, ওর বাবার দিদা’ বেগম হোসনে আরার লেখা “সফদার ডাক্তার” কে চিনলোনা, আমার বাবার লেখা, মায়ের লেখা বুঝলোনা ।
কার্ল মার্কস স্বপ্ন দেখেছিলেন পুরো পৃথিবীতে কোনো বর্ডার থাকবে না। আমি এখনো মনে প্রানে বিশ্বাস করি – পৃথিবীর বুকে এই আমেরিকা নামের ভূখণ্ডটিই হলো কার্ল মার্কসের বর্ডারলেস জগৎ। ধরিত্রী থেকে মানব-সৃষ্ট সীমা-রেখা আদৌ মুছে ফেলা কখনো সম্ভব কিনা তা জানিনা, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এই হলো সেই সীমানাহীন ভূখণ্ড যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক হয়ে সীমানাবিহীন এক জগতে মিলে মিশে একত্রে বসবাস করছে। আমেরিকান কে? আদিবাসী নেটিভ আমেরিকান ছাড়া যেই শপথ নিয়েছে সেই আমেরিকান।
আমি হাত তুলে নাগরিকত্বের শপথ নিয়েছি আমেরিকা নামের এই ভূখণ্ডটিকে ভালোবাসবো আমার জন্মভূমির মতোই। যে ভুখন্ড আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে নিজের দেশীয় সংস্কৃতি- স্বকীয়তা টিকিয়ে রেখেও একজন মানুষ হয়ে সবাইকে নিয়ে, সবার জন্য বাঁচা যায়।
আমি আমার জন্মভূমি আর আমার আবাসভূমির দোটানায় ভুগিনা। আমরা মানুষেরা এই ধরিত্রীকে সীমারেখা টেনে যতই বিভক্ত করিনা কেন, আসলেতো এই ধরিত্রী মাতা একটি সম্পূর্ণ একক স্বতন্ত্র সত্ত্বা! কানেক্টিকাটের যে মাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেই মাটিইতো আটলান্টিকের তলদেশ দিয়ে বহু দেশ পার হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে গিয়ে মিশেছে, আর সেই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেই আমার জন্মদাতা পিতা, আমার পূর্বপুরুষেরা।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট প্রবাসী। তাঁর প্রকৃত নাম রওনাক আফরোজ।
বিপি।সিএস