রওশন আলম পাপুল : বৃহস্পতিবার (৪ অক্টোবর) রাত পৌনে ১১টার দিকে দাদিকে ভর্তি করা হলো রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে। এর আগে বিকেলে গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় দাদিকে। সেখানে সন্ধ্যার পর নিজ দায়িত্বে জরুরী বিভাগের একজন ইন্টার্নি ডাক্তার এসে ব্লাড প্রেসার মাপার পর বললেন, রোগীর ব্লাড প্রেসার (রক্তচাপ) বাড়ছে। যে কোন সময় স্ট্রোক হতে পারে। তাই সেই ইন্টার্নি ডাক্তার দ্রত রোগীকে রমেক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভর্তি করাতে বললেন। বলা মাত্রই দাদিকে রমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলতে থাকলো আমাদের। এরই মধ্যে আমার স্বজনদের জানালাম, আমি সাথে যাবো আর থাকবোও। কেননা তখন আমার স্বজনরা চিন্তা করছিল, কে কে রংপুরে দাদির সাথে থাকবে। আমরাও দ্রত রাতেই দাদিকে রমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে রোগী ভর্তিসহ যাতায়াতে আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে বলে আমি সাথে আছি ভেবে আমার স্বজনরা দাদির চিকিৎসার বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। যা দেখভাল ও সহযোগিতা করার আমিই করবো।
রমেকে জরুরী বিভাগের সামনে পৌঁছামাত্রই একজন মহিলা একটা ট্রলি (রোগী বহনের গাড়ী) নিয়ে এসে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সেই গাড়ীতে দাদিকে তোলার পর জরুরী বিভাগের কক্ষের পাশে দাদীকে রাখা হলো। এরপর হাসপাতালের একজন পুরুষ লোক এসে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের রেফার্ড করা কাগজটি দেখতে চাইলেন। আমি তার হাতে কাগজটি তুলে দিলাম। এদিকে টিকিট কাউন্টারে রোগীর বিবরণ দিয়ে ভর্তির কাগজটি হাতে নিলাম। এখানে এই পুরুষ লোকটি ২০ টাকা করে চান। তাকে সেটা দিতে হয়। তিনি কেন জানি সেদিন আর চাইলেন না। (এর আগে দেখেছি, ২০ টাকা দেওয়ার বিষয়টি রোগী বহন করতে গাড়ী নিয়ে আসা মহিলাটিও মনে করিয়ে দেন। এই ২০ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত এই মহিলা রোগী নিয়ে ওয়ার্ডের দিকে যাননা। ওই পুরুষ লোকটির দেওয়া সিগনাল পেলে তবেই মহিলাটি রোগী নিয়ে ওয়ার্ডের দিকে যেতেন)।
সেদিন এই মহিলাটিও মনে করিয়ে দিলেন না। আমিও আর টাকা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম না। এরপর লিফট দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় লিফটম্যান ১০ টাকা চাইলেন। তাকে সে টাকাটা দিতে হলো। দাদিকে নিয়ে যাওয়া হলো দোতলার মেডিসিনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানকার সবগুলো বেড রোগী দিয়ে ভর্তি। মেঝেতেও ভর্তি রোগীদের রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ঢোকার পথে ও গেটের বাহিরে রয়েছে ভর্তি রোগী। সেখানেই চলে তাদের চিকিৎসা। পুরো ওয়ার্ডজুড়ে রোগীর লোকে গিজগিজ করছে। এসময় একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ নাকে ভেসে এলো। এই মহিলাটি দাদিকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে টাকা চাইলেন। তাকে দেওয়ার জন্য আমি ৮০ টাকা দিলাম। তিনি চলে গেলেন। এর আগে রোগী বহন করা মহিলারা ডাক্তারের রুম পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে যেতেন। কিন্তু সেদিন তিনি সেটা করলেন না।
আমি ভর্তির কাগজটা নিয়ে নার্সের রুমের দিকে গেলাম ডাক্তার কোথায় পাবো, সেটা জিজ্ঞাসা করতে। একজন ওয়ার্ডবয় জানালেন, মেডিসিনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে যান। সেখান থেকে ইন্টার্নি ডাক্তারকে নিয়ে আসেন। আমি গেলাম সেখানে ডাক্তারের খোঁজে। সেখানকার একটা রুমের দরজার পাশে দেয়ালে দেখতে পেলাম ‘এখানে বৃহস্পতিবারের ভর্তি রোগী দেখা হয়’। কিন্তু ভেতরে কোন ডাক্তার ছিলেন না। চার-পাঁচ মিনিট পরে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার আসলেন। তার সাথে ছিলেন কয়েকজন রোগীর লোক। আমি রুমে ঢুকলাম। ইন্টানি ডাক্তার রুমে ঢুকেই ভর্তি রোগীটির চিকিৎসা লিখছিলেন। তাকে বললাম, স্যার (তাদেরকেও স্যার বলে ডাকতে হয়, তা না হলে নাকি তারা মন খারাপ করেন, রোগীর লোকদের মারেনও) একজন নতুন রোগী এসেছে। তিনি উত্তরে বললেন, আমিও একজন নতুন রোগীর চিকিৎসা লিখছি। এরই মধ্যে আরেকজন রোগীর স্বজন এসে বললেন, তিনিও নতুন রোগী নিয়ে এসেছেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ইন্টার্নি ডাক্তার স্যারকে নিয়ে ছুটলাম দাদির কাছে। আমি সামনে থেকে তার যাওয়ার পথ ফাঁকা করতে করতে এগুতে থাকলাম। ডাক্তার স্যার, প্রথমে আমার পরে আসা স্বজনটির রোগীটিকে দেখলেন। কেননা আমার রোগীর কাছে যাওয়ার আগেই সেই রোগীটিকে রেখে যেতে হয়। তাই তিনি সেই রোগীটিকে দেখলেন। আমি আর কিছু বললাম না। এরপর আমার দাদিকে দেখার পর তার কক্ষে গিয়ে ইন্টানি ডাক্তার স্যার চিকিৎসাপত্র লিখলেন। সেখানেও আমার দাদির চিকিৎসা কি হবে সেটা লেখা হলো পরে। আমি আগে গিয়েও সেবা পেলাম পরে। আমি সেখানে থেকে বের হয়ে রাতের ওষুধগুলো কিনে নিয়ে আসলাম দোকান থেকে। রাত ১২টা বেজে যাওয়ায় আর ব্লাড ও ইউরিন পরীক্ষা করা হলো না। এই দোতলার মেডিসিনের ওয়ার্ডের সামনে রোগীর স্বজনদের বসার কোন ব্যবস্থা নাই। রাত আড়াইটা পর্যন্ত জেগে থাকার পর ওয়ার্ডের বাহিরে ফ্লোরে অন্য আর সবার মতো ঘুমালাম।
দীর্ঘদিন গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে অবস্থিত সন্ধানী ডোনার ক্লাবের সাথে জড়িত ও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করার কারণে হাসপাতালে রোগী ভর্তিসহ অন্যান্য বিষয়গুলো জেনেছিলাম। রংপুর মেডিকেলেও কয়েকবার গিয়েছিলাম অসুস্থ্য স্বজনদের নিয়ে। তাই দাদীকে ভর্তিসহ অন্যান্য কাজগুলো খুব সহজেই হলো আমার জন্য। কিন্তু অন্য কাজগুলো কি সহজ হবে আমার জন্য, পুরোটা জানতে হলে পড়তে থাকুন লেখাটা।
পরদিন শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে খেয়াল করলাম দাদির হাতের কেনুলা খুলে গেছে অনেকটা অংশ। এসময় দেখলাম পাশের বেডে ভর্তি রোগীর কাজ শেষে যাচ্ছিলেন একজন ইন্টার্নি নার্স। নার্স আপাকে বললাম দেখার জন্য। তিনি দেখে কেনুলা খুলে দিলেন। বললাম নতুন আরেকটা লাগিয়ে দেন। তিনি বললেন, পরের শিফটের আরেকজন এসে লাগিয়ে দেবেন। একথা বলেই তিনি চলে গেলেন। একজন ইমার্জেন্সি রোগীর প্রতি এই হলো সেবা প্রদান।
৮টায় শিফট চেঞ্জ হয়। এই নার্স আপাকে বলতে খুব ইচ্ছে করছিল, এই রোগী আপনার দাদি বা নানী হলে আপনি কি হাতের কেনুলা না লাগিয়ে চলে যেতে পারতেন? কথা কাটাকাটি হতে পারে ভেবে আর কথা বাড়ালাম না। শুধু শুনে গেলাম। এরপর ৯টার দিকে গেলাম নার্সদের রুমে। তারা জানালেন, রাউন্ডে গেলে নতুন আরেকটি কেনুলা তারা লাগিয়ে দেবেন। এরপর তাদের রাউন্ড শেষ হলো ১০টারও পর। কিন্তু তবুও দাদির হাতের কেনুলা কেউ লাগিয়ে দিল না। এবার নার্সদের রুমে গিয়ে সরাসরি বললাম, আপা দুইবার আসলাম। সকাল ৭টায় কেনুলা খুলে রাখা হয়েছে। ৩ ঘন্টা পার হয়ে গেল। তখন থেকে স্যালাইন বন্ধ রয়েছে। তবুও রোগীর একটা কেনুলা লাগিয়ে দেওয়া হলো না। তাদের মধ্যে থেকে একজন নার্স বললেন, রোগী কোথায় আছে? আমি তাকে জানালাম। তিনি বললেন, আপনি চলে যান, আমি আসছি। আমি আবার দাদির কাছে গেলাম। অথচ দুজনের তখন কোন কাজ ছিলনা। তারা বসে গল্প করছিলেন।
২ মিনিটেও কোন নার্স আসছেন না দেখে আমি এবার নার্সের রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। এরপর তাদের একজন নার্স আমাকে দেখে বের হলেন। আমি তাকে সাথে করে নিয়ে গেলাম দাদির কাছে। হাতে কেনুলা লাগানোর পর সেই নার্স আপা বললেন, এবার কেনুলা খুলে ফেললে ১০ ঘন্টাতেও আর লাগিয়ে দেব না। একটা কেনুলা হাতে লাগাতে সময় লাগলো তিন ঘন্টারও বেশি। এটাই কি জরুরী রোগীর সেবা? কেননা যখন গাইবান্ধার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি কোন রোগীর অবস্থা অবণতির দিকে যায়, তখন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর সেখানে গিয়েও যদি না মেলে কাঙ্খিত সেবা। তাহলে মানুষ রোগী নিয়ে যাবে কোথায়? কেনইবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল? আর কেনইবা সেখানে রোগীদের রেফার্ড করা হয়? এখন যদি আমি নার্সদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। তারাও যদি খারাপ ব্যবহার করতো, অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটতো, তাহলে তো দোষ আমার না থাকলেও আমারই শাস্তির দাবিতে তারা অনশন করতো। এতে করে অন্য রোগীরা কষ্ট পেত। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আর তাদের সাথে কথা ও খারাপ ব্যবহার করলাম না।
কেনুলা খোলার পর থেকে লাগানোর আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কল দিয়ে একজনকে ডাকলাম রক্ত ও ইউরিনের স্যাম্পল নেওয়ার জন্য। তিনি এলেন স্যাম্পল নিতে। একজনের পরামর্শক্রমে দাদিকে যে ইন্টানি ডাক্তার দেখেন আবার গেলাম তাদের রুমে। বৃহস্পতিবার রাতে যে ইন্টার্নি ডাক্তার দাদিকে দেখেছেন, তাকে পেলাম না। তখন সাড়ে আটটার মতো বাজে। তখন উপস্থিত আরেক ইন্টানি ডাক্তার স্যারকে বললাম, কিছু টাকা ছাড় করে দেওয়ার জন্য। তিনি ৪০% টাকা ছাড় করে দিলেন। ফলে অনেক বেশি উপকার হলো। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলাম। এরও অনেকক্ষণ পরে নতুন আরেকজন ইন্টার্নি ডাক্তার স্যার এলেন দাদিকে দেখতে। দেখা শেষে বললেন, এখন রোগীর ব্লাড প্রেসার নরমাল রয়েছে। ব্লাড প্রেসার চেক করলেনও মাত্র একবার। যাই হোক, কথা আর বাড়ালাম না। পরীক্ষা-নীরিক্ষার রিপোর্টগুলো যেন তাকে বিকেলে নিয়ে আসার পরে দেখাই, সেটা বললেন। আমি জানতে চাইলাম তিনি ততক্ষণ থাকবেন কিনা। তিনি উত্তরে জানালেন, তিনি থাকবেন।
পপুলার থেকে বিকেলে সাড়ে চারটার পর রিপোর্ট নিয়ে এসে সকালের ইন্টার্নি ডাক্তার স্যারকে দেখালাম। রক্তের পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট ভালো আছে। কিন্তু ইউরিনের ইনফেকশন (সমস্যা) আছে। এরপর কোন চিকিৎসা না দিয়ে তিনি বললেন, সন্ধ্যায় রাউন্ডে ডাক্তার আসবেন। তিনিই চিকিৎসা দেবেন। এরপর আমি চলে গেলাম। দুপুরের দিকে আমার পোষাকে পরিবর্তন ঘটলো, প্যান্টের বদলে লুঙ্গি আর গায়ে টি-শার্টের বদলে হাফ হাতা শার্ট। বিকেলের দিকে দাদি আবারও অস্থিরতা করতে থাকলেন ও এলোমেলো কথাবার্তা বলতে থাকলেন। মানে অসুস্থ্যতা বাড়তে থাকলো। আমি আবার গেলাম সকালের সেই ইন্টার্নি ডাক্তার স্যারের কাছে। তিনি আবারও বললেন, সন্ধ্যার পর ডাক্তার এসে চিকিৎসা দেবেন। তার কথা আর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম তিনি রোগীকে কি চিকিৎসা দেবেন তা বুঝতে পারছেন না। তাই তিনি আর গেলেন না রোগীর কাছে। তাই তাকে আর বিব্রতকর অবস্থায় ফেললাম না। চলে গেলাম দাদির কাছে। সময় বাড়ার সাথে সাথে সমস্যা বাড়তে থাকলো দাদির। আরেকবার গেলাম, গিয়ে দেখি রুমে তালা লাগানো।
রাতে ডাক্তারের রাউন্ড চলতে থাকলে আমি বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভেতরে রোগীর সাথে বড় আম্মা ছিলেন। রাউন্ড শেষে রাত ৯টার দিকে গেট খুলে দেওয়া হলে জানতে পারলাম, দাদিকে নাকি দেখেননি কোন ডাক্তার। রাউন্ড চলাকালীন সময়ে বৃহস্পতিবার রাতের ও শুক্রবারের ইন্টার্নি ডাক্তার স্যার দুজনকে দেখলাম একসাথে দাদির ওয়ার্ডে যাতায়াত করছেন। আমি ভাবলাম হয়তো তারা দাদিকেও দেখেছেন। কিন্তু না, তারা বা অন্য কোন ডাক্তার দাদিকে দেখেন নি। সাথে সাথে ডাক্তারের খোঁজে গেলাম ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইন্টার্নি ডাক্তারের রুমে। দেখলাম বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে দরজায়। পাগলের মতো খুঁজতে থাকলামমেডিসিনের ১ নম্বর ওয়ার্ড, ২ নম্বর ওয়ার্ড ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটা জুড়ে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না সেই পরিচিত ইন্টার্নি ডাক্তারদের মুখগুলো। ২ নং ওয়ার্ডের গেটের প্রবেশের মুখেই কয়েকজন ডাক্তার ও ইন্টার্নি ডাক্তার রোগী দেখছিলেন। বাধ্য হয়ে তাদের একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে জানতে চাইলাম আমার রোগীকে রাতে এখনো দেখা হয়নি।
ডাক্তার স্যার রোগীর ভর্তির কাগজটা হাতে নিয়েই বললেন, এই রোগীকে তো দেখা হয়েছে। যখন আমি জোড় দিয়ে বললাম, না দেখা হয়নি। এইতো রোগীর সাথে থাকা লোক এখানেই আছে। এরপর তিনি আবারও ভর্তির কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে হাসিমাখা মুখে বললেন, তাহলে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইন্টার্নি ডাক্তারদের রুমে যান। তখনই আমি বলে উঠলাম, ‘যেখানে দরজায় লেখা রয়েছে, এখানে বৃহস্পতিবারের রোগী দেখা হয়,’ সেই রুমে যাবো। সেই ডাক্তার তখন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইতো বুঝতে পারছেন। তাড়াহুড়োয় তাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেছি। ধন্যবাদ আপনাকে। শুনেই আমি দ্রত হাটা দিলাম সেই রুমের দিকে। আবারও দেখতে পেলাম রুমটা বন্ধ। পরে এই ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ঢোকার পথেই প্রথম যে ডাক্তারের রুমটা, সেটাতে ঢুকলাম। ডাক্তার ও ইন্টার্নি ডাক্তারদের দাদির রোগের বিষয়টি বললাম, ঘুমানোর ইনজেকশন লিখে দিতে বললাম। তাদের মধ্যকার একজন ইন্টার্নি ডাক্তার রোগীকে ঘুমানোর জন্য দুইটি ইনজেকশন লিখে দিলেন একটা কাগজে। সেটা কিনে নিয়ে এসে নার্সের মাধ্যমে দাদির শরীরে দেওয়া হলো।
পরদিন শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার পর আবারও জানতে পারলাম দাদিকে দেখেননি কোন ডাক্তার। সঙ্গে সঙ্গে আবারও মেডিসিনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ‘এখানে বৃহস্পতিবারের রোগী দেখা হয়’, সেই রুমে গেলাম। গিয়ে বৃহস্পতিবার রাতের সেই ইন্টার্নি ডাক্তারকে বিষয়টা বললাম। তিনি বললেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডেই রয়েছে ডাক্তার, কিন্তু কিভাবে চিনবো, নাম জানতে চাইলে তিনি নাম বললেন না। বললেন নাম বলা যাবে না। মাথায় কমলা রঙ্গের স্কার্ফ পরা আছে (গতকাল রোববার বিকেলে মাত্র ১৫ মিনিটেই কারও সহযোগিতা ছাড়াই নিজের চেষ্টাতেই খুঁজে পেয়েছি তার ফেসবুক আইডি)। আমি তাকে বললাম, গতকাল যিনি আপনার সাথে এখানে বসেছিলেন তিনি? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। এরপরও ৩ নম্বর ওয়ার্ড আরেকবার খুঁজে গেলাম। পরিচিত মুখটি দেখলাম না। শুক্রবার যিনি রোগী দেখেছিলেন তাকে দেখতে পেলাম ২ নম্বর ওয়ার্ডে। সেই ইন্টার্নি ডাক্তার স্যারসহ একজন ডাক্তার ও আরেকজন ইন্টার্নি ডাক্তার দেখছিলেন রোগী। দাঁড়িয়ে থাকলাম ১০ মিনিটের মতো।
এরপর সেই রোগীকে দেখা শেষ হওয়ায় সামনে এগিয়ে গেলাম, গিয়ে ডাক্তারের সামনেই ইন্টার্নি ডাক্তার স্যারকে বললাম, কাল রাত থেকে আমার রোগীকে দেখা হচ্ছে না। সাথে সাথে ডাক্তার বললেন, চলেন দেখি যাই। এরমধ্যে আবার আরেকজন রোগীকেও দেখা হলো আমার দাদির কাছে যাওয়ার পথেই। তারপর দাদির কাছে গিয়ে তিনি রোগের বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। বললাম সবকিছু। তারপর ডাক্তার বলতে লাগলেন, আমরা তো গেছিলাম কাল রাতে, হয়তো আপনার রোগীকে খুঁজে পাইনি। আর খুঁজে পাবোই বা কেমনে, এতো রোগী, একজন রোগীর সাথে এতজন করে লোক, খুঁজে পাবো কেমনে? সরকারকে বলেন আরও নতুন বিল্ডিং বানাতে। জনবল বাড়াতে। এখন অল্পতে সমস্যা হচ্ছে। আরও অনেক কিছু। (এই ডাক্তার স্যারকে তখন আর বলতে পারিনি যে, আমি সরকারকে জানানোর ব্যবস্থা করবো বিষয়গুলো।) তারপর নতুন চিকিৎসা দেওয়া হলো। ততক্ষণে আমার স্বজনরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন ডাক্তারদের প্রতি। তারা ডাক্তারদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করেন নি। শুধু বলেছেন, আমরা আর রোগী নিয়ে এখানে থাকবো না।
চিকিৎসা না পাইলে হাসপাতালে রোগী রেখে কি লাভ? আমি মনে মনে ভাবলাম কথা তো ঠিকই, আমি অভিজ্ঞ সম্পন্ন ছেলেটাও ব্যর্থ হয়ে গেলাম ডাক্তার আর নার্সদের কাছে। আর আমার স্বজনরা তো এসবের কিছুই বোঝেন না। আমার অনুপস্থিতিতে তারা কিভাবে কেমনে কি করবেন। অবশেষে স্বজনদের সিদ্ধান্তে অসুস্থ্য অবস্থায় দাদিকে বাড়ীতে নেওয়া হলো। ডাক্তাররা রাখতে বললেও তাদের কথায় আর কর্ণপাত করা হলোনা। এই হলো চিকিৎসা? যেখানে অভিজ্ঞতাও হার মানে। আমি অন্য বিভাগের অন্য ওয়ার্ডেও রোগী নিয়ে গেছি। সেখানে তো এতো অবহেলা ছিলনা। যতদূর মনে পড়ে, ২০১৩ সালের দিকে সন্ধানীর এক বড় ভাইয়ের বাবা অসুস্থ্য হওয়ায় তার সাথে রমেক হাসপাতালে গিয়েছিলাম। একদিন খেয়াল করলাম, আঙ্কেলের বিছানা থেকে ১০ ফুট দূরত্বের সামনে উপরে লাগানো লাইটের আলো তার চোখে লাগছে। এতে করে তার দেখতে সমস্যা হচ্ছে, তিনি ঠিকমতো চোখ মেলাতে পারছিলেন না। সেটা বুঝতে পেরে আমি সেই লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছায়া দিয়েছিলাম সেই আঙ্কেলের মুখে।
এই রমেক হাসপাতালে ৬ বারেরও বেশি গিয়ে যা বোঝা গেল, বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো যে গুরুত্ব দেয় এই রমেক হাসপাতালে সেই গুরুত্বটুকুও অনেকেই দেন না। কোন রোগীর অবস্থা অবণতির দিকে গেলে তখন সেই রোগীর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হয় বলেই জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয় রোগীদের। তা বোধহয় এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা জানেন না। এই পরিস্থিতি কি শুধুই এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাকি সারাদেশে? নিঃসন্দেহে যে কেউই বললেন, সারাদেশের। আমিও তাদের সাথে একমত।
তবে সেই সাথে এটাও লক্ষ্যনীয় যে, রোগীর তুলনায় ভবনের অবকাঠামো ও জনবল খুবই কম এখানে। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সরকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সারাদেশে যে ভবনের অবকাঠামো আর জনবলের পদ সৃজন করেছিলেন, সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে ১৮ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য। নতুন ভবন নির্মিত হলেও কিন্তু জনবলের নতুন পদ সৃজন করা হয়নি। তাহলে তো মানুষ সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেই। এজন্য সরকারকে বর্তমান জনসংখ্যার হিসেব করে নতুন পদ সৃজন করতে হবে, নতুন আরও ভবন নির্মাণ করতে হবে। তাহলেই হয়তো মানুষ পর্যাপ্ত জায়গায়, পর্যাপ্ত জনবলের জন্য প্রকৃত সেবাটা পাবে। আর এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতাটাও।
অনেকেই বলতে পারেন, আমার নিজের পরিচয়টা দিলে ভালো সেবা পাওয়া যেত। আমি তাদেরকে বলবো, তা হয়তো হতো। কিন্তু আসলেই কি সেই সেবা সব মানুষই পায়। এক সিনিয়র সাংবাদিকের কাছে থেকে শিখেছি, পরিচয় না দিয়ে সেবা নাও, দেখো তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করে। যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে সেই খারাপ ব্যবহারও নিশ্চয়ই তারা অন্য আর সবার সাথে করে। যদি তাই হয়, তাহলে সেই অসংগতিটা নিউজের মাধ্যমে তুলে ধরো। আর মানুষের সেবায় সেটাও একটা নিউজ।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক