আবু সাবেত: ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছেন নিউ ইয়র্ক প্রবাসী সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে তিনি সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ভারতের যা প্রয়োজন নিচ্ছে, কিন্তু প্রতিদানে তেমন কিছুই দিতে রাজি নয়। তারা এখন যা করছে তা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ। তাদের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াতে হবে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) নিউ ইয়র্কের বাংলা সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি ১৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও এই প্রথম তিনি প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
মঈন আহমেদ বলেন, সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারত সেদেশের মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন ও ত্রিপুরার আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক চ্যানেলে আমাদের আরো সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘে প্রমাণসহ ভারতের আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের চিত্র তুলে ধরতে পারেন। চীন, সৌদি আরব ও তুরস্কসহ বাংলাদেশের যেসব বন্ধু রাষ্ট্র আছে, তারাসহ বিভিন্ন ফোরামে প্রমাণসহ ভারতের আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের কথা তুলে ধরতে হবে।
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে বাংলাদেশে আক্রমণ চালাতে পারে বলে খবর শোনা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সতর্ক এবং প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের আপামর জনগণ জীবন দিতেও প্রস্তুত আছে।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ফিলিস্তিন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশে আক্রমণ চালালে আমাদের জবাব দিতে হবে। তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরাও দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত।
ভারত কেন এ সময়টাকে বেছে নিল- এই প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল মঈন বলেন, এতদিন তারা বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজনমত সবকিছু পাচ্ছিল এবং চুক্তিবদ্ধ ছিল। এখন হয়তো তারা এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, যা সময়ে প্রকাশ পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে মঈন ইউ. আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। প্রয়োজনে ২০ জানুয়ারির পর প্রধান উপদেষ্টা ট্রাম্পের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। এছাড়া বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাতে পারেন ট্রাম্পকে।
এই মুহূর্তে সকল ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মঈন ইউ. আহমেদ। দেশের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনীকে সতর্কতাও থাকার পরামর্শও দেন তিনি। সারা বিশ্বে কোটি প্রবাসীরাও এ ব্যাপারে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মন্তব্য করেন মঈন ইউ আহমেদ।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ১৪ জুন সেনাপ্রধান পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরপরই দেশ ছাড়েন মইন ইউ আহমেদ। পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার কয়েক বছর পর একবার হজ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন মইন। কিন্তু দেশমুখো হননি। এখনও আছেন যুক্তরাষ্ট্রেই। তবে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে দুই কক্ষের এক অ্যাপার্টমেন্টে দিন কাটছে এক-এগারোর অন্যতম এই কুশীলবের।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে দেশ ছেড়ে সোজা গিয়ে উঠেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। সেখানে ছিলেন তার ছোট ভাই ও ছেলে নিহাত আহমেদ। কয়েক বছর সেখানেই দিন কাটছিল মইনের। কিন্তু হঠাৎ শরীরে বাসা বাঁধে কর্কট রোগ (ক্যানসার)। চলে আসেন নিউইয়র্কের কুইন্সে, চিকিৎসার জন্য। এর মধ্যে পেয়ে যান গ্রিনকার্ড অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব।
সূত্রটি জানা্য, ২০০৯ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর আত্মগোপনের মতো আড়ালে ছিলেন মইন। ২০১৫ সালে ফ্লোরিডায়ায় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের এক মঞ্চে দেখা যায় তাকে। পরের বছর ফ্লোরিডার মায়মিতে অনুষ্ঠিত ফোবানা সম্মেলনের নৈশ্যভোজে এসে বিএনপি কর্মীদের তোপের মুখে পড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরের বছরের শেষদিকে হঠাৎ তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন স্থানীয় এক বাঙালির বিয়েতে।
নাগরিক হিসেবে কর্কট রোগের চিকিৎসাও পেয়েছেন তিনি স্থানীয় হাসপাতালে। কেমোথেরাপি, বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্টের পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার কিছুদিন পরই দেখা দেয় কিডনির জটিলতা। রোগে-শোকে কাবু হয়ে পড়েছেন এক-এগারোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
সেই সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মইন ইউ আহমেদ ছিলেন ছায়ার মতো। তার অঙ্গুলিহেলনে ঘটে যেত কত ঘটন-অঘটন। ওই সময় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সব অঘটনের মূলেও আছে তার নাম। প্রবল ক্ষমতাধর মইন এখন বিস্মৃতপ্রায়।
২০০৫ সালের ১৫ জুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন মইন। তার বছর দুই পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সরে গেলে প্রধান উপদেষ্ট হন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। এক-এগারো পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনী সরাসরি না থাকলেও সবখানেই যে তাদের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ ছিল এ কথা সর্বজনবিদিত, যে কারণে দেশে-বিদেশে ওই সরকার ‘সেনাসমর্থিত সরকার’ বলেই পরিচিত।
রাজনীতিতে জোর আলোচনা আছে, এক-এগারোর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অপ্রচেষ্টা করেছিল। তারই অংশ হিসেবে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানকে কারান্তরীণ করা হয়েছিল। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’, অর্থাৎ দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। আর এই মূলে অন্যতম কুশীলব হিসেবে ছিলেন জেনারেল মইন।
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতকি দলগুলো এক-এগারোর কুশীলবদের বিচারের দাবিতে একাট্টা হয়। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। যদিও এখন নিষ্পত্তি হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে এলে বিচারের মুখোমুখি এমনকি এক-এগারোর ক্ষতিগ্রস্তদের হামলার মুখে পড়তে হতে পারে, এই শঙ্কা থেকেও দেশমুখো হচ্ছেন না তৎকালীন কুশীলবরা।
বিপি।এসএম