১৪ অক্টোবর ২০২৫

এক বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার ৩৪১০ জন

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
এক বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার ৩৪১০ জন

বাংলাপ্রেস ডেস্ক:   এক বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন হাজার ৪১০ জন ব্যক্তি পাচার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ৭৬৫ জন যৌন পাচারের শিকার, দুই হাজার ৫৭২ জন জোরপূর্বক শ্রমের শিকার এবং ৭৩ জন অনির্দিষ্ট প্রকারের পাচারের শিকার। সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই পাচারের বিষয়টি শনাক্ত করেছে। তবে এক হাজার ৪৬২ পাচারের শিকার ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে ১৪৪ জন যৌন পাচারের শিকার, ২৮৫ জন জোরপূর্বক শ্রমের শিকার এবং এক হাজার ৩৩ জন অনির্দিষ্ট প্রকারের পাচারের শিকার। সরকারি হিসাবে আগের বছরের এক হাজার ২১০ জনের তুলনায় এই সংখ্যা বেশি।

 

যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদন ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৫’-এ এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে সোমবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ স্তরে রাখা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এই স্তরে আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার পাচার নির্মূলের জন্য ন্যূনতম মান সম্পূর্ণরূপে পূরণ করেনি। তবে এটি করার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার পূর্ববর্তী প্রতিবেদনের সময়কালের তুলনায় কিছুটা বেশি প্রচেষ্টা দেখিয়েছে, তাই বাংলাদেশ টায়ার ২-এ থেকে গেছে। এই প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে ভুক্তভোগী শনাক্তকরণ নির্দেশিকা এবং ফ্রন্টলাইন কর্মকর্তাদের জন্য মানসিক যত্নের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে একটি এনআরএম গ্রহণ করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকার আরও পাচারের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছে এবং তাদের সুরক্ষা পরিষেবাগুলোতে পাঠিয়েছে। তবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কম পাচারকারীদের বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করেছে এবং দোষী সাব্যস্ত করেছে। যৌন কাজে পাচার এবং জোরপূর্বক শিশুশ্রমসহ অভ্যন্তরীণ পাচারের অপরাধ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। শ্রম পরিদর্শকদের অনানুষ্ঠানিক খাতগুলো পর্যাপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ করার এবং শ্রমআইন লঙ্ঘনের জন্য সংস্থাগুলোকে জবাবদিহি করার ক্ষমতার মারাত্মকভাবে অভাব ছিল। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ফেরত আসা বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও পুনরেকত্রীকরণ প্রচেষ্টা অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। সরকার অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ অব্যাহত রেখেছিল, যা অনেক অভিবাসী শ্রমিককে ঋণগ্রস্ত করেছিল, পাচারের প্রতি তাদের দুর্বলতা বাড়িয়ে তুলেছিল।

প্রতিবেদনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুপারিশে বলা হয়, জড়িত কর্মকর্তাসহ পাচারের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে এবং দোষী সাব্যস্ত পাচারকারীদের জন্য পর্যাপ্ত শাস্তি চাওয়া, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কারাদণ্ড হওয়া উচিত। মানবপাচারের মামলার বিচার করার জন্য পাচারবিরোধী ট্রাইব্যুনালের কর্মীদের সক্ষমতা জোরদার এবং ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা প্রয়োজনীয় হারে বাড়ানো উচিত বলেও সুপারিশে বলা হয়।

সুপারিশে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে প্রবিধান প্রয়োগ এবং শ্রম নিয়োগ সংস্থা, দালাল (সাব-এজেন্ট) এবং দালালদের পর্যবেক্ষণ করুন, যারা নিয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কর্মী সরবরাহ করে। যার মধ্যে রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে নেওয়া নিয়োগ ফি বাদ দেওয়া এবং প্রতারণামূলকভাবে কর্মী নিয়োগকারীদের জবাবদিহি করা।

এছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাত পর্যবেক্ষণ, শ্রম আদালতে মামলা দায়ের এবং ফৌজদারি আদালতের তদন্তের জন্য মামলা রেফারসহ পাচারের অপরাধ শনাক্তকরণের জন্য শ্রম পরিদর্শকদের ক্ষমতা বাড়ানোর কথাও এতে বলা হয়।

প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসাবে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গা পাচারের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের তদন্ত ও বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা সেবায় রেফার করার জন্য সুস্পষ্ট পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করুন। পাচারের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ সংঘটিত বেআইনি কাজের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অনুপযুক্ত শাস্তি বন্ধ করুন। বাংলাদেশি পাচারের শিকারদের শনাক্ত ও প্রত্যাবাসন সহজতর করার জন্য ভারতের সঙ্গে ২০১৫ সালের সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন করুন।

রোহিঙ্গা পাচারে আ.লীগ সরকারের কিছু কর্মকর্তা জড়িত : রোহিঙ্গা পাচারে বিগত সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ট্রাফিকিং প্রোফাইলে বলা হয়েছে, ওই সরকারের কিছু কর্মকর্তা পাচারকারীদের অর্থের বিনিময়ে ক্যাম্পে প্রবেশের সুযোগ করে দিতেন। এছাড়া চাঁদাবাজি ও হয়রানির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিছু কর্মকর্তা রোহিঙ্গা পাচারে সহায়তা করেছেন। সেসব কর্মকর্তা পাচারকারীদের অর্থের বিনিময়ে ক্যাম্পে প্রবেশের সুযোগ করে দিতেন এমন অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজি ও হয়রানির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তারা।

ট্রাফিকিং প্রোফাইলে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েদের দোকানদার, জেলে, রিকশাচালক এবং গৃহকর্মী হিসাবে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। কক্সবাজারের আশপাশে পর্যটকদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মেয়েদের শোষণসহ যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। আরও বলা হয়, কক্সবাজার এবং ভাসানচর দ্বীপের ৩৩টি ক্যাম্পে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, ক্যাম্পে অপর্যাপ্ত তদারকি, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ ও সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠী, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শিশুসহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে নিয়োগ দেয়। এছাড়া শরণার্থীরা জোরপূর্বক নিয়োগসহ পাচারের শিকার হচ্ছেন। পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের পাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শোষণ করে।

পাচারকারীরা রোহিঙ্গা মেয়েদের বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারত, মালয়েশিয়া ও নেপালে যৌন ব্যবসায় নিযুক্ত করার জন্য পাচার করে। কখনো কখনো চাকরি বা বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাচার করে থাকে। বৈধ চাকরির ওপর সরকারি বিধিনিষেধের কারণে অনেক রোহিঙ্গা অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অভিবাসন করছে, ফলে তাদের পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে।

টিআইপি প্রতিবেদনে দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়। টায়ার-১-এ থাকে ন্যূনতম মান পূরণকারী দেশ। টায়ার-২-এ রাখা হয়, যারা পূর্ণ মান পূরণে ব্যর্থ হলেও উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে (বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান)। টায়ার-২ ওয়াচলিস্টে রয়েছে নেপাল ও মালদ্বীপ। আর টায়ার-৩ এ রাখা হয় ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ ও প্রচেষ্টা না নেওয়া দেশগুলোকে, যেখানে এ বছরও রয়েছে আফগানিস্তান।

৮১১ পাচার মামলার তদন্ত : সরকারের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে তিন হাজার ৩৩৪ জন সন্দেহভাজনসহ ৮১১টি মানব পাচার মামলা তদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৫টি যৌন পাচার, ২২৭টি শ্রম পাচার এবং ৪৬৯টি অনির্দিষ্ট প্রকারের পাচারের মামলা রয়েছে।

প্রতিবেদনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুপারিশে বলা হয়, জড়িত কর্মকর্তাসহ পাচারের তদন্ত ও বিচারের প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। দোষী পাচারকারীর জেল ও জরিমানা হওয়া উচিত। মানব পাচার মামলার বিচার ও পাচারবিরোধী ট্রাইব্যুনালের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাও বাড়ানো উচিত। কারণ, মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলার পরিমাণ বাড়ছে।

বিপি>টিডি

[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!

আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন