সাইফ উল্লাহ, ধর্মপাশা প্রতিনিধি: ১০৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রাণের উল্লাস দেখা গেছে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে। হাওরের এই পাঠশালা বিশ্বেশ্বরীর শত বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে শিক্ষক – শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণের জন্য এক হাজার ২৫৭ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী রেজিষ্ট্রেশন করে ছিলো। তাদের একজন হলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তিনি এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ায় শিক্ষক – শিক্ষার্থীদের আবেগপ্রবণ করে তুলেছে।
শুক্রবার (১০জানুয়ারি) সকাল ১০টার দিকে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রঙ্গণে ওই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের শতবর্ষপূর্তি উৎসব উদযাপন পরিষদ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সাড়ে ১০টার দিকে আনন্দ র্যালী করা হয়। ১১টার দিকে উদ্বোধন করা হয়। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের সমাপ্ত হবে।
এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ও প্রধান অতিথিরর বক্তব্য দেন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
আলোচনা সভায় উৎসব উদযাপন পরিষদের আহবায়ক বসন্ত কুমার বিশ্বাসের সভাপতিত্বে ও সাবেক শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন বাবুর সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন, জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া, পুলিশ সুপার আ.ফ.ম আনোয়ার হোসেন খান, সিলেট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান রমা বিজয় সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খুশী মোহন সরকার, মধ্যনগরের ইউএনও উজ্জল রায়, উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব বিজন কুমার তালুকদার, সহকারী অধ্যাপক গোলাম জিলানী, মধ্যনগর শিক্ষক সমিতির সভাপতি রমা রঞ্জন সরকার, সাবেক শিক্ষার্থী গোলাম হায়দার, অভী মঈন উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম তালুকদার, তুষার আলম প্রমুখ।
প্রধান অতিথিরর বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, যদিও এ অনুষ্ঠানে আমি প্রধান অতিথি প্রকৃতপক্ষে এ অনুষ্ঠানের আমিও একজন। তাই এ অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পেরে আমি অত্যান্ত আনন্দিত। ২০২০ সনে যখন অনুষ্ঠানটি হবে আমি কিন্তু রেজিস্ট্রেশন তখনই করেছি। তাই যারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন আমি তাদের থেকে ভিন্ন কেউ না। মূলত যারা বাইরে থেকে এসেছেন তারাই প্রকৃত গেস্ট। সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাকে প্রধান অতিথি করেছেন। আমাকে প্রধান অতিথ না করলেও আমি আসতাম। কারণ আমার স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে আমি আসবো না কেন? আমিত এখানের রেজিস্টার মেম্বার। তিনি বলেন পুরান ও নবীনদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে একটি এল্যামনাই ঘটন করতে হবে। যারা পুরোনো আছেন তারা যেন এই স্কুল ও কলেজের উন্নয়ন করতে পারে। আমি যেহেতু সরকারের একটি দায়িত্বে আছি সেই ক্ষেত্র বিভিন্নজন বিভিন্ন সমস্যা গুলো উপস্থাপন করবেন। যে সমস্যা গুলো আমার আওতায় রয়েছে আমি সেগুলো সমাধান করবো আর অন্য গুলো সমাধানের সহায়তা করবো।
যানা যায়, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের ধান – ঘিয়ের দেশে ‘জ্ঞানের দেবী’ বিশ্বেশ্বরী দেশীয় ধান আর ঐতিহ্যবাহী ঘি বিক্রির জন্য গড়ে উঠেছিল সুনামগঞ্জের মধ্যনগর বাজার। এক সময় ঘিয়ের বাজার বিলুপ্ত হলেও ধানের বাজার সুনাম বয়ে যাচ্ছে এখনও। জেলার সবচেয়ে অবহেলিত এ প্রান্তিক জনপদে শিক্ষা বিস্তারের বাতিঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। শতবর্ষী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন হাওরাঞ্চলের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত সর্বমহলে।
প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী বসন্ত কুমারের সাথে কথা বলে যানা যায়, তিনি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই করেছেন শিক্ষকতা। শিক্ষা ও চাকরি জীবনসহ দীর্ঘ ৫৭ বছর ধরে বিশ্বেশ্বরীর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মায়ার বাঁধনে। তাঁর বাবাও ছিলেন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়া কেউ কেউ বলছেন তিন পুরুষের বিদ্যাপীঠ এই প্রতিষ্ঠান।
আরও জানা যায়, ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে তৎকালীন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও মধ্যনগরের শিক্ষানুরাগীরা এই জনপদে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর মা বিশ্বেশ্বরী রায় চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল। এ সময় প্রতিষ্ঠানের স্থান ও খেলার মাঠসহ ৪ দশমিক ১৯ একর জমি ও নগদ অর্থ দেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক প্রয়াত রাকেশ চন্দ্র তালুকদারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে যাত্রা শুরু করে হাওরপারের জ্ঞানের তরী। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শাখা চালু করা হয়। বর্তমানে স্মৃতি রক্ষার্থে স্কুল প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠাতা ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ম্যুরাল।
১৯৭৪ সালে ধর্মপাশা উপজেলার অধীনে প্রশাসনিক মধ্যনগর থানার কার্যক্রম শুরু হয়। চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মধ্যনগর থানার নাগরিকদের চিকিৎসা, প্রশাসনিক সেবাসহ বিভিন্ন দুর্ভোগের কথা চিন্তা কার মধ্যনগরকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। ২০২২ সালের ১৯ জুলাই ইউএনওর যোগদানের মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এখনও কোনো প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়নি। ফলে মধ্যনগর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলা এবং এ বিদ্যাপীঠের কয়েকটি কক্ষে বিভিন্ন দপ্তরের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। উপজেলায় উন্নীত হওয়ার পরও এ উপজেলার নাগরিকদের এখনও বিভিন্ন সেবা পেতে ধর্মপাশা উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলা নেত্রকোনায় যেতে হচ্ছে।
শতবর্ষী এ বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান এখনও জাতীয়করণ না হওয়ার বিষয়টি সবাইকে ব্যথিত করেছে।
এদিকে, ২০১৯ সালে শতবর্ষপূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এর পর কোভিড সংক্রমণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে দু’বারই অনুষ্ঠানটি বাতিল হয়। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের যুগ্ম আহবায়ক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সিলেট শিক্ষা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার বলেন, দেরি করে হলেও অনুষ্ঠানটি করতে পারছি। এতে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক – শিক্ষার্থীসহ মধ্যনগরবাসীর মনে আনন্দের হিল্লোল বইছে। দীর্ঘ বছর পর শিক্ষক, সহপাঠী, অনুজ ও অগ্রজদের সঙ্গে দেখা হবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ বিদ্যাপীঠ মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি এখনো জাতীয়করণ করা হয়নি। তাই নবীন-প্রবীণের প্রাণের মিলন মেলায় প্রধান অতিথির কাছে জাতীয়করণের প্রস্তাব করা হয়।
বিপি/কেজে