বাংলাপ্রেস ডেস্ক: প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান খায়রুল বাশারের প্রতি আদালত প্রাঙ্গণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। পরে আদালতে শুনানিতে এই প্রতারণার বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সন্তানতুল্য এত শিক্ষার্থীকে কীভাবে প্রতারিত করলেন, সে প্রশ্ন তাঁকে করেছেন আদালত। জবাবে বাশার বলেছেন, তিনি পরিস্থিতির শিকার। তবে তিনি কী পরিস্থিতি শিকার, তা স্পষ্ট করেননি।
খায়রুল বাশারকে গতকাল সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আজ তাঁকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হবে, এ খবর শুনে সকাল থেকেই আদালতে ভিড় করতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। সকাল ১০টার পর থেকেই দুই শতাধিক ভুক্তভোগী আদালতের সামনে এসে খায়রুল বাশারের বিচার চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে আদালতে আনা হলে ভুক্তভোগীরা তাঁর বিচার চেয়ে আরেক দফা স্লোগান দেন। এরপর বৃষ্টির মধ্যেই এসব মানুষ আদালত চত্বরের হাজতখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন।
বেলা তিনটার পর কড়া পুলিশ পাহারায় খায়রুল বাশারকে হাজতখানা থেকে বের করে আনে পুলিশ। এ সময় তাঁর মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁকে যখন আদালত ভবনের নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় ওঠানো হচ্ছিল, তখন বিক্ষুব্ধ লোকজন তাঁর উদ্দেশ্যে ডিম ছুড়তে থাকেন। এসব ডিম গিয়ে লাগে খায়রুল বাশারের মাথা, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের শরীরে।
একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা বিক্ষুব্ধ লোকজনকে শান্ত হতে বলেন। তখন তাঁরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ পর্যায়ে প্রতারিত বিক্ষুব্ধ লোকজন খায়রুল বাশারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। পরে তাঁকে আদালত ভবনের তিনতলায় এজলাসকক্ষে নিয়ে যায় পুলিশ।
কাঠগড়ায় তোলার পর বাশারের মাথায় থাকা হেলমেট খুলে ফেলে পুলিশ। বাশার তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আপনার তো জীবন জেলেই কেটে যাবে’
খায়রুল বাশারকে কাঠগড়ায় তোলার পর আদালতকক্ষে থাকা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে স্লোগান দেন। বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাসে আসেন। এ সময় বাশারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক খালিদ সাইফুল্লাহ সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান। আদালতের অনুমতি নেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, খায়রুল বাশারের প্রতিষ্ঠান ১৪১ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ১৮ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী প্রতারিত হওয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আমাদের জানামতে, আরও অনেক শিক্ষার্থী বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন।’
এ পর্যায়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী জামাল উদ্দিন খন্দকার আদালতকে বলেন, ‘এই খায়রুল বাশার কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানোর নাম করে এক হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অন্তত চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিগত তিন থেকে চার বছর এসব শিক্ষার্থী তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন। বিদেশে না পাঠাতে পারলেও তিনি কোনো শিক্ষার্থীকে টাকা ফেরত দেননি। টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে যেসব চেক তিনি দিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যাংক থেকে বারবারই প্রত্যাখাত হয়েছে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, শত শত শিক্ষার্থী প্রতারিত হয়ে বিচার চেয়ে খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে বহু মামলা করেছেন। সেসব মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। প্রতারিত ব্যক্তিরা যাঁরা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের অফিসে যেতেন, বাশারের লোকজন তাঁদের মারধর করতেন। তিনি বাশার বাহিনী গঠন করেছিলেন।
খায়রুল বাশারের লোকজনের হাতে মারধরের শিকার ব্যক্তিদের ছবিও আদালতের সামনে উপস্থাপন করেন এই আইনজীবী। একই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে খায়রুল বাশারের ছবিও আদালতের কাছে তুলে ধরেন তিনি।
এ সময় উপস্থিত এক আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি খায়রুল বাশারের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি। এই আদালতে বিচার চেয়ে মামলাও করেছি। আমার মতো আরও ৭০ থেকে ৮০ জন এই আদালতে খায়রুল মাশারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আমার ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।’
এ পর্যায়ে ঢাকার সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সমাজে যে ব্যক্তি শিক্ষায় অবদান রাখেন, তিনি একজন সম্মানিত মানুষ। বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাসার শিক্ষাকে ব্যবসায় রূপান্তর করেছেন। তিনি মানুষকে প্রতারিত করেছেন। শত শত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন। তিনি কয়েক শ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির বক্তব্যের পর ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম সানাউল্লাহ বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের খায়রুল বাশারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কীভাবে এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন?’
জবাবে খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি পরিস্থিতির শিকার।’
এ পর্যায়ে আদালত তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
খায়রুল বাশার আদালতকে জানান, তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
আদালত খায়রুল বাশারের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার কয় সন্তান, কয়টি বিয়ে করেছেন?’
খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি দুটি বিয়ে করেছি। আমার পাঁচটি সন্তান রয়েছে।’
আদালত বলেন, ‘আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানোর নাম করে শত শত শিক্ষার্থীকে বিদেশে না পাঠিয়ে তাঁদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাঁরা তো আপনার সন্তানতুল্য। আপনি কীভাবে আপনার সন্তানতুল্য এত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করলেন? আপনি এতগুলো মানুষকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন!’
আদালত খায়রুল বাশারের উদ্দেশে আরও বলেন, ‘আপনার নামে কতটি মামলা রয়েছে, আপনি জানেন?’ জবাবে খায়রুল বাশার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমার জানামতে ৭০টি মামলা রয়েছে।’ তখন আদালত তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে যত মামলা, যত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আপনার তো জীবন জেলেই কেটে যাবে।’ এ সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন খায়রুল বাশার।
এ পর্যায়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী জামাল হোসেন বলেন, ‘মাননীয় আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ খায়রুল বাশারের ১০ দিন রিমান্ড চেয়েছে। আমরা মনে করি, তাঁকে ১০ দিনের রিমান্ড দেওয়া হোক। এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। তিনি শত শত শিক্ষার্থীকে প্রতারিত করে, তাঁদের জীবনকে নরকে পরিণত করেছেন। তিনি একজন অপরাধী।’
উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত খায়রুল বাশারকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেন।
এজলাস থেকে খায়রুল বাশারকে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন আবার স্লোগান দিতে থাকেন। প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে কানাডায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে খায়রুল বাশার ১০ লাখ টাকা নেন। আমাকে তো নিয়ে যাননি। আমার টাকাও ফেরত দেননি। এই টাকা জোগাড় করার জন্য আমার বাবা সুদে টাকা এনে দিয়েছিলেন। সেই সুদের টাকা এখনো পরিশোধ করতে হচ্ছে।’
বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি > এস পি