তৌফিক ইসলাম: মানুষ মানুষের জন্য, এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রচলিত উক্তি, কিন্তু বাস্তবতা কখনও কখনও এই ধারণার বিপরীত। পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষ তাদের আশেপাশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে, কিন্তু একই সাথে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে, মানুষ একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করে। তাহলে কেনো মানুষ মানুষের সাহায্য করতে চায় না বা করতে পারে না? এর পেছনে নানা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এসব কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো।
বেশ কিছু মানুষের মধ্যে নিজেকে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তাদের মনে থাকে না যে, অন্যদের সাহায্য করাও জীবনের অংশ। যখন কেউ শুধুমাত্র নিজের উন্নতি, সুখ বা ভালোবাসায় মনোযোগ দেয়, তখন তারা সাধারণত অন্যদের সমস্যাকে গুরুত্ব দেয় না। এই ধরনের স্বার্থপর মনোভাব সমাজে নেগেটিভ প্রভাব ফেলতে পারে, এবং এর ফলে মানুষ অন্যকে সাহায্য করতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে।
মানুষ সাধারণত সাহায্য করতে চায়, কিন্তু অনেকের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব থাকে। অনেকেই মনে করে যে, যদি তারা অন্য কাউকে সাহায্য করে, তবে সেই সাহায্য প্রকৃতভাবে কাজে আসবে না। এমনকি অনেকের মধ্যে এই ধারণাও থাকে যে, তাদের সাহায্যের ফলে অন্যরা লাভবান হলে তা তাদের নিজেদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি সমাজের মধ্যে বিশ্বাসের অভাবও সাহায্য না করার আরেকটি বড় কারণ।
অনেকসময় মানুষ নিজেদের জীবনে এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে, তাদের আশেপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তারা অবগত থাকে না। কাজের চাপ, পারিবারিক সমস্যা বা ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা তাদের মনোযোগ অন্য দিকে টেনে নেয়, ফলে তারা অন্যের কষ্ট বা সংকট বুঝতে পারে না বা সেটা নিয়ে চিন্তা করার সময় পায় না। এই অবহেলা বা অজ্ঞতা মানুষের সাহায্য না করার আরেকটি কারণ।
একটি সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন অনেকসময় মানুষের সাহায্য করার প্রবণতাকে দমন করে। উচ্চ শ্রেণির মানুষরা নিম্ন শ্রেণির মানুষের সমস্যার প্রতি কম মনোযোগী হতে পারে, কারণ তারা মনে করে তাদের জীবনের সঙ্গে অন্যদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কিত নয়। এই ধরনের বিভাজন মানুষের মধ্যে মনের শীতলতা তৈরি করে এবং সহানুভূতির অভাব সৃষ্টি করে।
বর্তমান যুগে মানুষের মানসিক চাপ বেড়েছে। তারা নিজের জীবনেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, যেমন কর্মসংস্থান সমস্যা, সম্পর্কের জটিলতা, আর্থিক সংকট ইত্যাদি। এসব কারণে অনেকের মধ্যে হতাশা এবং উদ্বেগ তৈরি হয়, যা তাদের অন্যদের সাহায্য করতে অক্ষম করে তোলে। তাদের মনে হয়, তারা যদি নিজেই সংকটে থাকে, তবে অন্যদের সাহায্য করার মতো শক্তি তাদের নেই।
অনেক মানুষ ভয় পান যে, তাদের সাহায্য যদি ব্যর্থ হয়, বা অন্যরা তাদের সাহায্য গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে। আবার, কিছু মানুষ মনে করেন যে, অন্যকে সাহায্য করার ফলে তারা নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করবেন, যা তাদের আত্মসম্মান হানি হতে পারে। ফলে, তারা সাহায্য করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে।
আবার কিছু পরিস্থিতিতে, মানুষের মনে এমন হতাশা বা অসহায়ত্বের জন্ম নেয় যে তারা মনে করে যে, একমাত্র ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাই সবকিছু সমাধান করতে পারবে। এমনকি তারা ভাবতে থাকে, একা বা আত্মনির্ভর হওয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান হতে পারে, এবং এজন্য তারা অন্যের সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়।
মানুষ মানুষের জন্য, এই ধারণাটি আমরা সবাই বিশ্বাস করি, কিন্তু বাস্তবে এই আদর্শের বাস্তবায়ন সবসময় সম্ভব হয় না। স্বার্থপরতা, অবহেলা, বিশ্বাসের অভাব, সামাজিক বিভাজন, মানসিক চাপ এবং ভয়—এসবই মানুষের সাহায্য না করার কারণ হিসেবে কাজ করে। তবে, যদি আমরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতি এবং সহায়তার মনোভাব তৈরি করতে পারি, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবে এবং মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি বাড়বে।
শুধু ব্যক্তি নয়, একটি সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগও প্রয়োজন, যাতে মানুষের মধ্যে সাহায্যের প্রতি আগ্রহ এবং বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। যদি প্রত্যেক ব্যক্তি একটু একটু করে পরিবর্তন আনতে পারে, তবে পুরো সমাজের মধ্যে সাহায্য এবং মানবিকতা বৃদ্ধি পাবে।
বিপি/টিআই