১৪ অক্টোবর ২০২৫

'মামা হালিম' এর মামা রহস্য !

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
'মামা হালিম' এর মামা রহস্য !

রাজধানীর কলাবাগানের ঐতিহ্যবাহী ‘মামা হালিম’র নাম শোনেননি এমন রসনাপ্রিয় মানুষ মেলা ভার। তাঁর তৈরি হালিম এতটাই জনপ্রিয় যে, ‘মামা হালিম’ নামেই ক্রেতা একনামে চেনেন। ‘মামা’ শব্দটির নিচে চাপা পড়ে গেছে তাঁর প্রকৃত নাম দীন মোহাম্মদ মনু।

কীভাবে তিনি ‘মামা’ পরিচিতি পেলেন? জিজ্ঞেস করতেই সযতনে রাখা অতীতের ঢাকনাটা যেন খুলে গেল। মুচকি হেসে দীন মোহাম্মদ মনু বললেন, ‘শৈশবে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলাম আজমির শরিফে খাজাবাবার দরবারে। সেখান থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোরাফেরা করতাম। অনেকের ফুটফরমাশ খাটতাম। পরে মোহাম্মদপুর বিহারি কলোনিতে এক রেস্তোরাঁয় সাগরেদের কাজ শুরু করি। হালিম তৈরি শিখেছি সেখানেই। সেই রেস্তোরাঁর সবাই আমাকে মামা ডাকত।’

সেই থেকে আপনি সবার ‘মামা’ হয়ে গেলেন! ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন’, দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘এরপর ভাগ্নেদের ভালোবেসে নিজেই হালিমের দোকান দিলাম। ১৯৭৫ সালের কথা। এই কলাবাগানের ছোট একটা ছাপড়া ঘরেই শুরু করেছিলাম।’

না, এখন আর ছাপড়া ঘর নেই। দালান উঠেছে। বেড়েছে প্রসার, আরেকটি শাখাও খুলতে হয়েছে গ্রাহকের চাপে। বয়সটাও বসে থাকেনি। এই ৬৩ বছর বয়সে ফিনফিনে পাতলা সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি পরে এখনও নিজেই ব্যবসার দেখাশোনা করেন দীন মোহাম্মদ। শুধু তাই নয়, হালিমের রেসিপিও সিক্রেট। শুধু জানালেন, তিনি যখন হালিম বিক্রি শুরু করেন তখন ঢাকায় এককভাবে হালিমের কোনো দোকান ছিল না।

‘ঢাকাই খাবার’ গ্রন্থে সাদ উর রহমান লিখেছেন, মোগল আমলে দরবারি খাবার ছিল হালিম। মোগল অধিপতি, সেনানায়ক, সুবেদারদের নাশতার প্রিয় খাবার ছিল এটি। তবে ঢাকায় কবে থেকে এর প্রচলন, কেন এর নাম হালিম হলো, কে প্রথম তৈরি করেছিল এই খাদ্য তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। রাজধানীবাসীর কাছে সুস্বাদু ও উপাদেয় এই খাবারের নাম বলতে গেলে সবার আগে আসে ‘মামা হালিম’-এর কথা। হালিম খেতে খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর। খাবারটি এখন এতোই জনপ্রিয় যে, তারকা হোটেল থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের অনামি রেস্তোরাঁয় এটি তৈরি হয়, বিক্রিও হয় দেদার।

আপনার তৈরি হালিমের স্বাদ অন্যদের থেকে আলাদা। কীভাবে তৈরি করেন? জানতে চাইলে দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘হালিম তৈরিতে একশ প্রকারের মশলা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নাম বলা যাবে না। আমি মারা যাওয়ার আগে দুই সন্তানের যে রাজি হবে তাকে শিখিয়ে যাব। এছাড়া আর অন্য কাউকে এই ফরমুলা বলা যাবে না।’

তবে তিনি জানালেন, প্রধানত সাত রকমের ডাল লাগবে। অড়হরের ডাল ছাড়া হালিম সুস্বাদু হবে না। আরও লাগবে সুগন্ধি চাল, মরিচ, হলুদ, ধনে, জিরা, দারুচিনি, এলাচসহ গরমমশলা, গোলমরিচ, মৌরি, মেথি ও সরিষা। তার সঙ্গে যুক্ত হবে গরু, খাসি বা মুরগির মাংস।

পরিবেশনেও রয়েছে কেরামতি। মামা নিজেই জানালেন, এসময় কাঁচামরিচ, আদা, ধনেপাতা, বেরেস্তা, শসার কুচি দিতে হবে। সবশেষে অবশ্যই এক টুকরো লেবু। নইলে হালিমের স্বাদ খুলবে না। তিন ধরনের মশলার মাত্রা ঠিক করার মধ্যেই রয়েছে হালিম তৈরির ওস্তাদি। শীত ও গরমের মৌসুমে মশলার মাত্রায় পরিবর্তন আনতে হয়। গরু, খাসি ও মুরগি- তিন রকমের হালিম তৈরি করেন মামা। কিন্তু মাংস যা-ই হোক, মশলাটা দিতে হবে একই পরিমাণে।

মামার দাবি, ঢাকায় হালিম জনপ্রিয় করেছেন তিনি। কর্মচারীরা কাটা-বাছাসহ অন্যান্য কাজ করলেও ডাল ও মশলা মিশ্রণের কাজটি তিনি নিজ হাতে করেন। কারণ এখানেও কিছু ওস্তাদি রয়েছে। কী রকম? জানতে চাইলে মামা বলেন, ‘স্বাভাবিক আবহাওয়া ও গরমের প্রভাব পড়ে মানুষের শরীরে। তখন মশলার অনুপাত কমবেশি রাখতে হয়। মরিচ ব্যবহারে থাকতে হয় সতর্ক। আজ বাজার থেকে যে মরিচ এনেছি, সেটা এক রকম ঝাল। কাল হয়তো আরেক রকম থাকবে। মরিচ ভেঙে জিভে স্পর্শ করে দেখতে হয় ঝালের তেজ। প্রতিদিন একই পরিমাণ মরিচ দেয়া যাবে না। যেসব মশলা ব্যবহার করি, বেশির ভাগ মানুষ সেগুলোর নামও জানে না।’

দীন মোহাম্মদ মনুর বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাকসামে। স্বাধীনতার আগে মোহাম্মদপুরের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশে এক বিহারির হোটেলে কাজ করতেন। এই হোটেলেই তাঁর ওস্তাদ কালা, ধলার কাছে শিখেছিলেন হালিম তৈরির কৌশল।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সেরাজুল ইসলাম বাসার জন্য হালিম কিনছিলেন। তিনি বললেন, মামা হালিমের স্বাদ অতুলনীয়। শীত আসছে। এই সময় হালিম খেতে ভালো লাগে। বেইলি রোডের বাসিন্দা সায়মন বলেন, এত স্বাদের হালিম অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। প্রতিদিন তো কেনা সম্ভব হয় না, আজ এদিকে এসেছিলাম পার্সেল নিয়ে যাচ্ছি। দাম একটু বেশি হলেও স্বাদের কারণে মানুষ কিনে নিয়ে যায়। পাত্রের আকার ও হালিমের পরিমাণ অনুযায়ী মামা হালিমের মূল্য ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০ টাকা।

বিপি/আর এল

[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!

আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন