
মাত্র তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার
ট্রাম্পের মনোনয়ন ব্যর্থ, মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার
মাচাদো নোবেল পুরস্কারের প্রকৃত চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন


আবু সাবেত: নরওয়ের নোবেল কমিটি শুক্রবার ঘোষণা করেছে, ভেনেজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন মারিয়া কোরিনা মাচাদো।
কমিটির চেয়ার জোরগেন ওয়াতনে ফ্রিডনেস শুক্রবার সকালে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে বলেন, মাচাদো নোবেল পুরস্কারের প্রকৃত চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন—একজন ঐক্যবদ্ধকারী নেতা হিসেবে, যিনি শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এমন এক সময়ে যখন ভেনেজুয়েলা ও বিশ্বের অনেক স্থানে গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে।
'ভেনেজুয়েলার ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের নেতা হিসেবে মারিয়া কোরিনা মাচাদো লাতিন আমেরিকার অসামান্য বেসামরিক সাহসিকতার এক অনন্য উদাহরণ' বলেন ফ্রিডনেস।
তিনি আরও যোগ করেন, 'গণতন্ত্র টিকে থাকে তাদের কারণে, যারা নীরব থাকতে অস্বীকার করে, যারা ভয় থাকা সত্ত্বেও সামনে আসে, এবং যারা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতাকে কখনোই স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেওয়া যায় না—এটি সর্বদা শব্দ, সাহস এবং দৃঢ় সংকল্প দিয়ে রক্ষা করতে হয়।'
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের আশা ছিল খুবই ক্ষীণ। মনোনয়নের শেষ তারিখ ছিল ১ ফেব্রুয়ারি, তার দ্বিতীয় মেয়াদের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর। তখনও তিনি তার ভাষায় 'সাত মাসে সাতটি যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ' শুরু করেননি যেগুলোর বেশ কয়েকটি এখনো অমীমাংসিত।
ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি মনোনয়ন আবার সময়সীমা পেরিয়ে জমা পড়ে। রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান ক্লডিয়া টেনি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ট্রাম্পের ২০২০ সালের 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস' ইসরায়েল ও দুটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ঐতিহাসিক চুক্তি—এর স্বীকৃতিতে একটি মনোনয়ন জমা দেন।
তবুও, এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের জন্য এক নতুন ক্ষোভের কারণ হবে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অভিযোগ করে আসছেন, নোবেল কমিটি আব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেয়নি। ২০২১ সালের শান্তি পুরস্কার, যা আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের জন্য প্রযোজ্য হতে পারত, দেওয়া হয়েছিল ফিলিপাইন ও রাশিয়ার দুই সাংবাদিককে, যারা নিপীড়নের মধ্যেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করছিলেন।
শুক্রবারের ঘোষণার কিছুক্ষণ আগেই ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন করেছেন, যা তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। এ ঘোষণার পর ইসরায়েলি নেতারা ও ট্রাম্পের সমর্থকেরা দাবি তোলেন—এই শান্তি প্রচেষ্টার জন্য ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্য।
'এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি এই পুরস্কারের যোগ্য, সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তবে স্বাধীন নোবেল কমিটির প্রধান নরওয়েজিয়ান পত্রিকা ভিজি-কে জানান, এ বছরের পুরস্কার নিয়ে সিদ্ধান্ত সোমবারই চূড়ান্ত হয়েছে।
নোবেল কমিটির সমালোচনায় ট্রাম্প বরাবরই সরব। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভার্জিনিয়ায় শতাধিক সামরিক নেতাদের এক সমাবেশে তিনি বলেন, “আমাকে যদি এই বছরও শান্তি পুরস্কার না দেওয়া হয়, তবে এটি আমাদের দেশের প্রতি এক ধরনের অপমান হবে।”
তার এই প্রকাশ্য ক্ষোভই সম্ভবত তার বিপরীতে কাজ করেছে। অসলো শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিনা গ্রেগার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানান, 'কমিটি কখনোই রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না।'
২০২৪ সালের উত্তর ক্যারোলিনার এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প আবারও অভিযোগ তোলেন যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অযৌক্তিকভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'ওবামা কিছুই করেননি। আমি যা করেছি, তা অবিশ্বাস্য—শুধু আব্রাহাম অ্যাকর্ডসই যথেষ্ট।'
বাস্তবে, আব্রাহাম অ্যাকর্ডসই এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের সবচেয়ে শক্তিশালী দাবিদার পদক্ষেপ, যেহেতু এটি মধ্যপ্রাচ্যে বহু পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন ও শান্তি প্রচারে সহায়ক হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, যা ইরান ও তার মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের মধ্যেও টিকে আছে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প তার শান্তি উদ্যোগ জোরদার করেছেন, তবে তার সাফল্য এখনো বিতর্কিত। তিনি ইসরায়েল-ইরান, কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ভূমিকা রাখেন বলে দাবি করেন।
তবে ভারত প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সংঘাত মীমাংসায় বড় কোনো ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে, কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে, যদিও ট্রাম্প দাবি করেছেন তিনি সেটি 'শেষ করেছেন।' ইথিওপিয়া ও মিশরের মধ্যে বাঁধসংক্রান্ত দ্বন্দ্বও এখনো অমীমাংসিত।
তবুও, জাতিসংঘে সেপ্টেম্বরে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, সবাই বলে আমি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত, আমি সাতটি সংঘাত বন্ধ করেছি।'
তবে শান্তির দূত হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুললেও ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে আক্রমণাত্মক সামরিক পদক্ষেপও নিয়েছেন—যেমন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা, ভেনেজুয়েলায় মাদকচক্রের বিরুদ্ধে “সশস্ত্র অভিযান” ঘোষণা, এমনকি মার্কিন শহরগুলোতেও সেনা মোতায়েন।
তিনি স্বীকার করেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতে রাজি করানো তার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
ইউক্রেনের সংসদ সদস্য ওলেক্সান্দর মেরেজকো জুন মাসে ট্রাম্পের নোবেল মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন, কারণ তিনি 'বিশ্বাস হারিয়েছেন যে ট্রাম্প যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবেন।'
বর্তমানে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় শান্তি চ্যালেঞ্জ হলো গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা, ২০ জন জীবিত ও ২৮ জন নিহত জিম্মির দেহ ফেরত নিশ্চিত করা, এবং প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।
হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ট্রাম্পের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই তাকে এই শান্তি প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ করছে। ইতিমধ্যে তিনজন ইসরায়েলি নোবেল বিজয়ী ও ইসরায়েলি বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ঘোষণা দিয়েছেন, ট্রাম্প যদি সফলভাবে যুদ্ধবিরতি আনতে পারেন, তারা তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করবেন।
এ পর্যন্ত মাত্র তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন— প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (১৯১৯) লিগ অব নেশন্স গঠনের জন্য, প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট (১৯০৬) রুশ-জাপানি যুদ্ধের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (২০০৯) আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে জোরদার করার জন্য।
অবসরে গিয়ে ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পুরস্কার পান আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসনে ভূমিকার জন্য, আর ২০০৭ সালে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজের স্বীকৃতিতে পুরস্কৃত হন।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের শান্তি পুরস্কার পান জাপানের 'নিহন হিদানক্যো' সংগঠন—হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ১৯৪৫ সালের পারমাণবিক বোমা হামলার বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বের জন্য। আর ২০২৩ সালে পুরস্কার পান ইরানের কারাবন্দি মানবাধিকার কর্মী নার্গিস মোহাম্মদি।
বিপি/সিএস
আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন



সামরিক সংঘর্ষের পর আফগান সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি পাকিস্তানের

ভুটান থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনলে দুই দেশেরই উপকার: হামু দর্জি

মিশরে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গাজা শান্তিচুক্তিতে সই করলেন ট্রাম্প
