ফরিদপুর প্রতিনিধি : ফরিদপুরের সালথায় গুজব ছড়িয়ে ওই তান্ডবলীলায় অংশ নেওয়া হাজারো জনতার মধ্যে পিছন থেকে মদদের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
সরেজমিনে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগ জানা যায়। রাতের ওই তান্ডবে অংশ নিয়েছিল প্রায় ৫ হাজার মানুষ। স্থানীয় মাওলানা আকরাম আলীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে এমন মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে লোকজনকে হামলার জন্য মদদ দেওয়া হয়। যদিও মাওলানা আকরাম আলী এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা অনুপ্রবেশকারীদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এ ঘটনার নেপথ্যে। আর এ কারনেই শেষমেশ ঘটনাটি বড় আকার ধারন করে।এলাকাবাসী আরো জানান,গত ২৫ জানুয়ারি সালথা বাজারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের সময় উপজেলা প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হন সালথা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইমারত হোসেন পিকুল ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল হোসেন।
এ নিয়ে পিকুল, বাদল ও তাদের সমর্থকরা প্রকাশ্যে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সে সুত্র ধরেই সোমবারের ঘটনায় তারাই হামলাকারীদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠি-সোঠা,ঢাল-কাতরা তুলে দিতে দেখা গেছে বলে নাম প্রকাশ্যে অনেকেই জানান।
এ বিষয়ে ইমারত হোসেন পিকুল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি এই হামলার সঙ্গে জড়ীত নন, বরং তার এলাকা রামকান্তপুরের উত্তেজিত জনতাকে তিনি নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। অভিযোগ সঠিক নয় দাবী করে একই মন্তব্য করেছেন বাদল হোসেন। তিনি বলেন, এই হামলার সঙ্গে শুধু বিএনপি-জামাতের লোকজনই জড়িত।
সেদিনের সেই তান্ডবের নেপথ্যে এই দু’জনের বাইরেও আরও বেশ কয়েকজনের নামে অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে একজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান। স্থানীয় রামকান্তপুর ইউনিয়নের ভাওয়াল গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মাতুব্বর জানান, ঘটনার সূত্রপাতের স্থান সেই ফুকরা বাজারের পল্লি চিকিৎসক ও বিএনপির সমর্থক কাউসারের সমর্থকরাই এসিল্যান্ডের গাড়ি তাড়া করেছিল। তবে ঘটনাটি বড় আকারে নিতে অন্যদের উস্কানি দেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াহিদুজ্জামান ও তার সমর্থকরা।
সালথা তান্ডবে গুজব ও উস্কানির পাশাপাশি উপস্থিতির অভিযোগ পাওয়া গেছে নগরকান্দা উপজেলার আশফরদী গ্রামের মো. আক্তার শেখের । তিনি হেফাজত ইসলামের একজন সক্রিয় কর্মী তিনি দীর্ঘদিন ধরেই জেলার বিভিন্ন থানায় হেফাজত ইসলামের সকল কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হেফাজতের ডাকা হরতালের আগের দিন সে ভাঙ্গা থানা ঘেরাও ও ভাংচুরের সাথেও জড়িত ছিলো বলে জানা গেছে তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে মামলা থেকে বেঁচে যায়। গতকাল সালথা থানার অগ্নিসংযোগ ও তান্ডবেও সে স্বশরিরে উপস্থিত ছিলো। আক্তার শেখের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করে মোবাইল বন্ধ থাকায় পাওয়া যায়নি।
সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী দেলোয়ার হোসেন বলেন,সোমবারের তাণ্ডবে মূল অংশগ্রহণকারী বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতপন্থিরা হলেও এর নেপথ্যে স্থানীয় নব্য আওয়ামী লীগারদের কয়েকজন নেতার বেশ ভূমিকা রয়েছে।
বল্লভদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম এমন অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন এলাকার বিএনপির লোকজনকে সংগঠিত করে এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে নব্য আওয়ামী লীগারদেরও কয়েকজন ছিলেন। তাদের অন্যতম মাঝারদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাহিদুজ্জামান সাহিদ। সাহিদুজ্জামান আগে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আমি আগে বিএনপি করলেও উল্লেখযোগ্য পদপদবি ছিল না। দলের মধ্যে গ্রুপিং থাকায় প্রতিপক্ষ আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। দাবি করে তিনি বলেন,হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। সাহিদুজ্জামান সাহিদ বলেন,হামলার বিষয় আমি পরের দিন জেনেছি। আমি সালথায় থাকি না,আমি ফরিদপুরে থাকি। আমার জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।
হামলার সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মী জড়িত থাকার বিষয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওয়াদুদ মাতুব্বর বলেন, আমরা অনেক কিছুই জানি, কিন্তু অবস্থানের কারণে বলতে পারি না।
স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম আলী বলেন, সোমবার রাতে চালানো তাণ্ডবের ঘটনা এখনও তা চোখে ভাসছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, সালথা দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা হলেও এমন ঘটনা কখনও ঘটতে দেখিনি। এ ধরনের ভয়াবহ তাণ্ডব প্রথম দেখলাম।
বৃহস্পতিবার(৮ এপ্রিল) সালথা সহিংসতায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ৭ নেতৃবৃন্দ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রহমান। এরমধ্যে রয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রহমান, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, যুগ্ন সাধারন সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, ডা. দিপু মনি,আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল ও মির্জা আজম। বিকেলে তারা সালথা থানা এলাকায় যান।
উল্লেখ্য, গত সোমবার(৫ এপ্রিল)সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজারে লকডাউনের কার্যকারিতা পরিদর্শনে যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি। এ সময় সহকারী কমিশনারের উপস্থিতিতে মানুষ ছুটাছুটি করে। পরে স্থানীয়রা জড়ো হয়। মানুষের ভীড় দেখে এসিল্যান্ড ফুকরা বাজার থেকে চলে আসেন।পরে গুজব ছড়িয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ উপজেলা চত্বরে দেশীয় অস্ত্র ঢাল-কাতরা ও লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন সরকারি দফতর ও থানায় এই তান্ডব চালায়। মধ্যযুগীয় কায়দায় হামলাকারিরা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের গুলিতে দুই জনের মৃত্যু হয়।পুলিশ ৫৮৮ রাউন্ড শট গানের গুলি, ৩২ রাউন্ড গ্যাস গান, ২২ টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৭৫ রাউন্ড রাইফেলের গুলি ছুড়ে।