Home কলাম মোমেনের ‘বেহেশত’ আর জাকিরের ‘জাহান্নাম’ সমাচার

মোমেনের ‘বেহেশত’ আর জাকিরের ‘জাহান্নাম’ সমাচার

by bnbanglapress
A+A-
Reset

ছাবেদ সাথী: বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের এমন মন্তব্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের মুখ ফসকে ‘আমরা কায়মনে দোয়া করবো বঙ্গবন্ধুকে যেন আল্লাহ জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়’ বক্তব্যে দেশ ও বিদেশের মানুষসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল ঝড়। কথা বলার সময় বেশি চাটুকারিকা করতে গিয়ে খুনি খন্দকার মোস্তাকের মতো অভিনয় করতে গেলেই এমন ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গত শুক্রবার (১২ আগষ্ট) সকালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের ‘ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক’ মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক ছড়ানো হচ্ছে যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।’ সুইজারল্যান্ডের কাছে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য আবারও চাওয়া হবে কি না, এর জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়, তাদের কাছে তথ্য চাওয়া হলে তারা তথ্য দিতে চায় না। এটা তাদের মজ্জাগত সমস্যা।’
‘অতীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৭ জনের নামোল্লেখ করে সুইস ব্যাংকে তাদের অর্থের তথ্য চাওয়া হয়েছিল, সেসময় তারা শুধু একজনের তথ্য দিয়েছিল। আরও কয়েকবার তথ্য চাওয়া হলেও রাষ্ট্রদূত বলছেন তথ্য চাওয়া হয়নি।’ তিনি সুইজারল্যান্ডকে বাংলাদেশের বন্ধু দেশ উল্লেখ করে তথ্যের বিভ্রাট না করার আহ্বান জানান।
এর আগে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী।
উপস্থিক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে রিজিওনাল হাব হিসেবে ব্যবহার করতে এ বিমানবন্দরে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। রানওয়ে বড় করাসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নতুন টার্মিনাল ভবনের কাজ চলছে। আগামীতে সিলেট থেকে নিউইয়র্কে সরাসরি ফ্লাইট যাবে।’
এদিকে জাতীয় শোক দিবসে কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদত বার্ষিকীতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত কর্মসূচিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বক্তব্যের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি স্লিপ অব টাং ছিল।
সোমবার (১৫ আগষ্ট) বিকেলে রাজীবপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শোক দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।
ওই বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে বলতে শোনা যায় ‘আমরা কায়মনে দোয়া করবো বঙ্গবন্ধুকে যেন আল্লাহ জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়’। অনুষ্ঠানটি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা ফেসবুকে লাইভ ও ভিডিও ধারণ করেছিলেন। মুহূর্তে এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়।
এ বিষয়ে রাজীবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই সরকার বলেন, বিষয়টি আসলে ‘স্লিপ অব টাং’ হয়েছে। তিনি পরক্ষণেই সংশোধিত বক্তব্য দিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সাথে মোবাইল ফোনে সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে কথা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, শোক দিবস উপলক্ষে দিনব্যাপি কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ভুলবশত তিনি জান্নাত শব্দটি না বলে জাহান্নাম শব্দ উচ্চারণ করেছেন। এটি ‘স্লিপ অব টাং’।
‘জাহান্নাম শব্দটি বলার সাথে সাথে আমি সংশোধন করে জান্নাত শব্দটি ব্যবহার করি এবং পরবর্তীতে কয়েকবার জান্নাত শব্দ উচ্চারণ করি,’ তিনি বলেন।
কথা বলার সময় যেটা বলার কথা সেটা না বলে মনের অজান্তে আরেকটা বলে ফেলাই হচ্ছে ‘স্লিপ অব টাং’। সাধারণত মানুষ মনের অজান্তে সম্পূর্ণ বিপরীত শব্দটাই বলে ফেলে। কিংবা যে শব্দটা নিয়মিত বলতে বলতে অভ্যস্ত কিংবা যে শব্দটা মনে বেশিরভাগ লালন করেন সেটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। যেমন-একজন রাজনৈতিক নেতা কোথায়ও বক্তৃতা দিচ্ছেন। হয়তো তিনি দল পরিবর্তন করে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এখন এই নেতা আওয়ামী লীগের কোনো একটা সভায় বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা না বলে, বলে দিলেন খালেদা জিয়ার নাম। মূলত এটাকেই বলা যাবে ‘স্লিপ অব টাং’ বা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া। যদিও এটা এমন একটা ভুল যা শোনার জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল মঞ্চে বসা বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে জাগপা নেতা শফিউল আলম প্রধান বলেছিলেন ‘আমরা আর এক মূহুর্তে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’ অথচ সেই সময় ক্ষমতায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে তার ভুল সংশোধন করে দিয়েছিলেন।
দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ওয়াজের বক্তারা ঠান্ডা মাথায় নিজেকে জাহির করার জন্য অসংখ্য ভুলভাল কথা বা ফতোয়া দিয়ে থাকেন। অতি সাম্প্রতি কয়েকজন বক্তা ধরাও খেয়েছেন। অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রী কিংবা উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ইচ্ছে করেই বেফাঁস কথা বলে ফেলে। পরে যখন প্যাঁচ লাগে তখন বিবৃতি দেন, সাংবাদিকরা ভুল শুনেছেন। আমি এভাবে কথাটা বলিনি। আরও অবাক হই তখন যখন সেইসব ভুল আরেকজন তুলে ধরে ক্ষমা চাইতে বলেন। তখনও চ্যালেঞ্জ করেন যে, তিনি ভুল করেননি। যখন পাবলিক সমালোচনা-বিতর্ক বেড়ে যেতে থাকে তখন বাধ্য হয়ে বলেন-বক্তব্য দেওয়ার সময় ‘ওটা স্লিপ অব টাং’ হয়ে গেছে। তাহলে ভুলটা এতো দেরিতে কেনো স্বীকার করা হলো? তারমানে আদতে এটা ভুল করে বলেননি জেনে বুঝেই বলেছেন, এটাই প্রমাণ করে।
এতো নাম থাকতে বিপরীত ধারার নামটা কেনো মুখে আসলো? এটার প্রধান কারণ তার মেমোরীতে যেটা বেশিদিন ধরে লালন করেছেন এবং ইতোপূর্বে বলে অভ্যাস করে ফেলেছেন, ফলে এখন মনের অজান্তে এই শব্দটা এসে গেছে। এটা তিনি ইচ্ছা করে করেননি, ভুল করে এসে গেছে। কীভাবে বুঝবেন তিনি সত্যি সত্যি স্লিপ করেই এটা বলেছেন? যখন দেখবেন, বক্তা ভুল বলার বা করার পর স্মরণ হওয়া মাত্রই ভুল স্বীকার করে সংশোধন দিবেন, সাথে দুঃখ প্রকাশও করছেন।
কিন্তু যখন জেনে বুঝে কেনো বিষয়ে মতামত রাখা হয় যা বিশ্লেষণধর্মী, সেখানে কতগুলো বক্তব্য সরাসরি উদ্দেশ্যমূলক বলা হয় সেটা কিছুতেই ‘স্লিপ অব টাং নয়’। “স্লিপ অব টাং’ হয় কেবল একটা শব্দ, পুরো বাক্য কখনও স্লিপ হয় না। পুরো বাক্য শুনার পর যখন শ্রোতাদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তখন ঠেলা সামলাতে না পেরে বলে এটা ‘স্লিপ অব টাং”। যা স্বজ্ঞানে বলা হয় সেটা কিছুতেই ‘স্লিপ অব টাং’ নয়। এটা নিজেকে বাঁচানোর রাজনৈতিক কৌশল।
কেউ যদি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে তখন মনে পড়ার সাথে সাথে বক্তৃতার স্থলেই দুঃখ প্রকাশ করে সংশোধন করা নেয়। কিন্তু বহু বিতর্কের পর যখন বাঁচার জন্য বলে “ঐটা স্লিপ অব টাং” ছিলো। তারমানে এটা তার সুচিন্তিত বক্তব্য ছিলো ‘স্লিপ অব টাং’ ছিলো না। কারণ যদি সত্যিকার অর্থে ‘স্লিপ অব টাং’ হয়ে থাকতো তাহলে পানি ঘোলা করার পর বলা হতো না আগেই অর্থাৎ ভুল ধরা পড়ার সাথে সাথে বলা হতো ‘সরি। ‘স্লিপ অব টাং’ চেনার সাধারণ উপায় বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরল স্বীকারোক্তি।

বেহেশত ও জাহান্নাম প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেলো। এক মুমিন মুসলমানের ধর্মীয় কাজ কর্মে আল্লাহ খুশি। তার মৃত্যুর পর বিচারে তাকে বলা হলো বেহেশত বা দোজখ যেখানে খুশি তুমি যেতেও পারো। তোমার জন্য সব কিছুই উন্মুক্ত। এখানে তুমি পুরোপুরি স্বাধীন। ভদ্রলোক বেহেশতে যাবার জন্য মনস্থির করলেন। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো একটু দোজখটা দেখে আসি, পরে বেহেশতে যাবো। দোজখে গিয়ে দেখলেন বিনোদনের সব ব্যবস্থা রয়েছে। হলিউড, বলিউড আর ঢালিউডের নায়ক-নায়িকারা গিজগিজ করছে। বড় বড় পর্দায় হিন্দি আর বাংলা সিনেমার গানে সবাই নাচে মাতোয়ারা। লুঙ্গি ড্যান্সের সাথে কিছুক্ষণ বিনোদন করলেন ভদ্রলোক। ভালমন্দ সব কিছু দেখে ফিরে গেলেন বেহেশতের দিকে। সেখানে প্রবেশের পর দেখলেন হরেক রকম খাবারে ভরপুর। অবাধে হুরদের কাছে যাতায়াত। সিনেমার নায়ক-নায়িকা বা বিনোদনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তাই তিনি আবার মত পাল্টিয়ে দোজখে যাবার জন্য মনস্থ করলেন। এবার দোজখে গিয়ে আগের সেই বিনোদন আর দেখতে পেলেন না, সেখানে যাবার সাথে সাথেই ফেরেস্তারা কোপাতে শুরু করলেন। কোপাতে কোপাতে তার অবস্থা নাজেহাল করলেন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন এর আগে এখানে এসেছিলাম। দেখলাম নায়ক-নায়িকারা গিজগিজ করছে। হিন্দি আর বাংলা সিনেমার গানে হরেক রকমের নাচ। এখন আমাকে মারছেন কেন? জবাবে ফেরেস্তারা বললেন এর আগে যা দেখেছো ওটা ছিল ‘দোজখের বিজ্ঞাপন’। ওই বিজ্ঞাপন না দেখলে তুমি দোজখে আসতে চাইতে না।

— ছাবেদ সাথী, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক। সম্পাদক-বাংলাপ্রেস ডটকম

 

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী