Home কলাম হোয়াইট হাউসে মঞ্চস্থ হলো নাটক ‘অফ দ্য রেল’

হোয়াইট হাউসে মঞ্চস্থ হলো নাটক ‘অফ দ্য রেল’

by bnbanglapress
A+A-
Reset

 

ছাবেদ সাথী
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার চেষ্টাগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে হওয়া উত্তপ্ত হোয়াইট হাউস বৈঠকের পর, যা সাম্প্রতিক বছরের মধ্যে অন্যতম নাটকীয় দৃশ্য হয়ে ওঠে ওভাল অফিসে।
শুক্রবার জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে পৌঁছেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ চুক্তি স্বাক্ষর ও মস্কো এবং কিয়েভের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের আশ্বাস পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু আলোচনার শুরুতেই তা ভেস্তে যায়, যখন ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘অশ্রদ্ধাশীল’ বলে আখ্যা দেন এবং বলেন তিনি ‘শান্তির জন্য প্রস্তুত নন’।
গত এক মাস ধরেই ট্রাম্প প্রশাসন ও জেলেনস্কির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে চলছিল, বিশেষ করে জেলেনস্কির কিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
প্রথমদিকে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে স্বাগত জানিয়ে ইউক্রেনীয় সেনাদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন এবং শান্তি দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু খুব দ্রুতই বৈঠক চিৎকার, অভিযোগ আর আঙুল তোলার লড়াইয়ে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অভিযোগ করেন জেলেনস্কি অকৃতজ্ঞ এবং তার হাতে কার্যকর কোনো কৌশল নেই।
বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার মুহূর্তটি আসে যখন ভ্যান্স বলেন ট্রাম্প কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন আর জেলেনস্কি প্রশ্ন তোলেন জেডি কেমন কূটনীতি বলছেন? তিনি উল্লেখ করেন যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বারবার যুদ্ধবিরতি ভেঙেছেন এবং ইউক্রেনীয়দের হত্যা করেছেন। কথা বলার সময় জেলেনস্কি হাত নেড়ে ভ্যান্সের দিকে ইঙ্গিত করেন।
ভ্যান্স পাল্টা বলেন, ‘আমি এমন কূটনীতির কথা বলছি যা আপনার দেশের ধ্বংস ঠেকাবে’। জেলেনস্কি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ভ্যান্স বলেন, ‘শ্রদ্ধাসহ ওভাল অফিসে এসে আমেরিকান মিডিয়ার সামনে এসব আলোচনা করা আপনার পক্ষে সম্মানজনক নয়।’
এরপর জেলেনস্কি ভ্যান্সকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কখনো ইউক্রেনে এসেছেন? আমাদের সমস্যাগুলো নিজের চোখে দেখেছেন?’ ভ্যান্স বলেন, ‘আমি সব খবর দেখেছি।’
জেলেনস্কি যখন বলার চেষ্টা করেন যে, আমেরিকা এখনো পুরোপুরি যুদ্ধের প্রভাব বুঝতে পারেনি, তখন ট্রাম্প রেগে গিয়ে বলেন,
‘আপনি জানেন না। আমাদের কী হবে তা আমাদের বলতে আসবেন না।’
ট্রাম্প বলেন, ‘আপনার হাতে কোনো কার্ড নেই। আমাদের সঙ্গে থাকলেই কিছু কার্ড হাতে পাবেন। আপনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন এবং এটা খুবই অসম্মানজনক এই দেশের প্রতি, যে দেশ আপনাকে সমর্থন দিয়েছে।’
ভ্যান্স বলেন, এই বৈঠকে একবারও কি ধন্যবাদ বলেছেন?’ জেলেনস্কি উত্তর দেন, ‘অনেকবার বলেছি।’
জেলেনস্কি বলতে শুরু করেন, আপনি যদি শুধু যুদ্ধের ব্যাপারে জোরে জোরে বলেন’ তখনই ট্রাম্প বাধা দিয়ে বলেন, ‘সে জোরে কিছু বলছে না, আপনার দেশ বড় সমস্যায় আছে। আপনি জিতছেন না। আমাদের কারণে আপনার ভালোভাবে বেঁচে ফেরার সুযোগ আছে।’
বৈঠকের পর, হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প ও জেলেনস্কি আলাদা ঘরে চলে যান এবং ইউক্রেনীয়রা আলোচনায় ফিরে আসতে চেয়েছিল। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ জানান, ট্রাম্পের নির্দেশে তাদের হোয়াইট হাউস ছাড়তে হবে এবং শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত হলে ফেরার পরামর্শ দেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প মনে করেন, বৈঠকে জেলেনস্কির শরীরী ভাষা ও মন্তব্য ছিল অসম্মানজনক।
বৈঠকের পরের যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। সাংবাদিকরা চলে যাওয়ার কিছু পরেই, জেলেনস্কির গাড়ি ওয়েস্ট উইংয়ের সামনে আসে যা তার আগেভাগে বিদায়ের ইঙ্গিত দেয়। তিনি দ্রুতই হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা দিনটির ঘটনাপ্রবাহকে ইতিবাচক হিসেবে দেখিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের সরকারি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে জেলেনস্কির গাড়ি প্রাঙ্গণ ছাড়ার ভিডিও পোস্ট করা হয়। প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ট্রাম্প ও ভ্যান্স ‘আমেরিকান জনগণের স্বার্থ রক্ষা করছেন।’
মার্কো রুবিও, যিনি বৈঠকে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বসে ছিলেন, পরে এক্স-এ লেখেন, ট্রাম্প ‘আমেরিকার পক্ষে এমনভাবে দাঁড়িয়েছেন, যেভাবে কোনো প্রেসিডেন্ট আগে সাহস করেননি।’
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। ২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রথম অভিশংসনের সময় জেলেনস্কি কেন্দ্রে ছিলেন, যখন ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ করেন ট্রাম্প ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা আটকে রেখে বাইডেন পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে চাপ দিয়েছিলেন।
২০২৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সহায়তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, যা বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কংগ্রেসের রিপাবলিকানরাও ক্রমশ ইউক্রেন-সহায়তা থেকে সরে আসছিল, যার মধ্যে ভ্যান্সও ছিলেন।
সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন জেলেনস্কির ওপর ক্ষুব্ধ হয়, যখন তিনি কিয়েভ সফরে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের সঙ্গে অভদ্র আচরণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হননি জেলেনস্কি, যা ট্রাম্পের অসন্তোষ বাড়ায়।
সম্প্রতি ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘নির্বাচনহীন স্বৈরশাসক’ বলে আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধ শুরুর দায় ইউক্রেনের ওপর চাপান। জেলেনস্কি পাল্টা বলেন, ট্রাম্প ‘ভুল তথ্যের দুনিয়ায় বাস করছেন’ এবং রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন।
বৈঠকের দিন ট্রাম্প জেলেনস্কির কালো পোশাক নিয়ে ঠাট্টা করেন, যা যুদ্ধকালীন সময়ে তার চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি আপনার পোশাক পছন্দ করি।’
এই বৈঠক নিয়ে মস্কোতে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। রুশ নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ এক্স-এ লেখেন,
‘ওভাল অফিসে অবশেষে সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ শূকরটি যোগ্য জবাব পেল। ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন কিয়েভ প্রশাসন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে খেলছে।’
অধিকাংশ রিপাবলিকান ট্রাম্পের অবস্থানকে সমর্থন করে, বলেছেন তিনি আমেরিকান স্বার্থ রক্ষা করছেন। সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, ‘আজকের ঘটনা দেখে বেশিরভাগ আমেরিকানই জেলেনস্কিকে তাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানাতে চাইবেন না। আমি নয়বার ইউক্রেনে গিয়েছি, আর কখনো ট্রাম্পকে নিয়ে এত গর্ববোধ করিনি।’
শুক্রবারের সংঘর্ষ ইউরোপীয় নেতাদের আরও উদ্বেগে ফেলেছে, যারা সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্পকে শান্তি আলোচনায় রাখতে চেষ্টা করছিলেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ইউরোপ ইতোমধ্যেই অনেক সহায়তা করেছে এবং স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
ম্যাক্রোঁ পরে বলেন,’রাশিয়া আগ্রাসী, ইউক্রেন ভুক্তভোগী। আমরা সঠিকভাবেই ইউক্রেনকে সাহায্য করেছি এবং রাশিয়াকে শাস্তি দিয়েছি-এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে।’

ছাবেদ সাথী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি, লেখক ও সাংবাদিক। সম্পাদক-বাংলা প্রেস

[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

বিপি।এসএম

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী