ছাবেদ সাথী
এপ্রিল মাসে পেনসিলভানিয়ার গভর্নরের বাসভবনে আগুন লাগানোর পর সেই অগ্নিসংযোগকারী দাবি করেন, তিনি এটি করেছেন কারণ গভর্নর জোশ শ্যাপিরো (ডেমোক্র্যাট) “ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে যা করতে চাইছেন”।
এরপর ২১ মে, ওয়াশিংটন ডিসির ইসরায়েলি দূতাবাসে কর্মরত দুই তরুণ কূটনীতিককে ইহুদি জাদুঘরের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযুক্ত, ৩০ বছর বয়সি শিকাগোর বাসিন্দা, গ্রেফতারের সময় “ফ্রি প্যালেস্টাইন” বলে চিৎকার করছিলেন। আদালতের নথিতে পরে দেখা যায়, তিনি বলেছিলেন, “আমি গাজা-র জন্য এটি করেছি।”
১০ দিন পর কলোরাডোর বোল্ডারে, একজন মিশরীয় নাগরিক যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছিলেন, একটি ইসরায়েলি জিম্মিদের সমর্থনে আয়োজিত কর্মসূচিতে নিজ হাতে তৈরি দাহ্য বস্তু ব্যবহার করে উপস্থিত জনতাকে আগুনে পুড়িয়ে দেন। এরপর তিনি গাজায় বেসামরিক লোকজন নিহত হওয়া নিয়ে চিৎকার করতে থাকেন- যদিও নিজে বেসামরিক লোকদের উপর হামলা চালিয়ে তার প্রতিবাদের বার্তাকে হাস্যকর করে তোলেন।
এই হামলাগুলোর পেছনে-অথবা বলা যায় উৎসাহদাতার ভূমিকায়- রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে “প্রো-প্যালেস্টাইন” আন্দোলনের ছদ্মবেশে ছড়িয়ে পড়া ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য ও কার্যকলাপ। গত বছর, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীরা “একটাই সমাধান, ইন্তিফাদা বিপ্লব” স্লোগান দেয়। বোল্ডার এবং ওয়াশিংটনের হামলাগুলো যেন এই স্লোগানেরই বাস্তব রূপ।
এই ঘটনা নতুন কিছু নয়; আরব-ইসরায়েল সংঘাতকে কেন্দ্র করে পশ্চিমে বহু বছর ধরে রাজনৈতিক সহিংসতা চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা প্রায়ই বিশ্বাস করে বসে যে, তারা ফিলিস্তিনের উপকার করছে -যদিও ইতিহাসে তার কোনো প্রমাণ নেই।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময়, ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা পশ্চিম জার্মানির তথাকথিত “শহুরে গেরিলা”দের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। ১৯৬০-এর দশকে বার্লিনের ছাত্র আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় জুন সেকেন্ড মুভমেন্ট, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন মাইকেল “বোমি” বাউমান। ছিনতাই ও সহিংসতার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু হলেও, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর তারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
বাউমান এবং তার সঙ্গীরা জার্মান কর্মকর্তাদের হত্যা করে, একজন শিল্পপতিকে অপহরণ করে এবং নিজেরাই এক ‘বিশ্বাসঘাতক’ সদস্যকে হত্যা করে। একইভাবে বাদের-মাইনহফ গ্যাং (বা রেড আর্মি ফ্যাকশন)-এর মতো ইউরোপীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর আরব সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালের মধ্যে, ফিলিস্তিনি গেরিলারা রেড আর্মি ফ্যাকশন এবং জুন সেকেন্ড মুভমেন্টের সদস্যদের অস্ত্র, বিস্ফোরক এবং প্রচারণামূলক প্রশিক্ষণ দেয় জর্ডানে। ১৯৭০-এর দশকে তাদের সহিংস কর্মকাণ্ড পশ্চিম বার্লিনের উচ্চ আদালতের প্রধানকে হত্যা, একজন ধনী ব্যক্তিকে অপহরণ এবং নিজেদেরই একজন সদস্যকে হত্যা পর্যন্ত গড়ায়।
ভেনেজুয়েলার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইলিচ রামিরেজ সানচেজ, যিনি ‘কার্লোস দ্য জ্যাকাল’ নামে পরিচিত, ১৯৬০-এর দশকে ফিলিস্তিনি আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হন। তার জীবনীকার জন ফোলেইন লিখেছেন, ছয় দিনের যুদ্ধ ছিল বিশ্বজুড়ে বামপন্থী ছাত্রদের জন্য “বিপ্লবের ডাক”। পিএলও-র নেতা ওয়াদি হাদ্দাদের ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কার্লোস বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ইসরায়েল ধ্বংস হলেই ফিলিস্তিন মুক্ত হবে এবং একটি বৈশ্বিক বিপ্লব শুরু হবে।
ফ্রেঞ্চ বিশেষ বাহিনী ১৯৯৪ সালে সুদানে অভিযান চালিয়ে কার্লোসকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে কয়েকটি যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন তিনি। জেলে থেকেই তিনি বলেছিলেন, “ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে আমিই সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছি।” বাউমানও ১৯৮১ সালে গ্রেফতার হন, কয়েক বছর পর তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে নিহত হওয়ার পর।
হামাসের মতো জঙ্গি সংগঠন একটি মিথ্যা মুক্তির স্বপ্নে সন্ত্রাসকে বৈধতা দিতে চায়, এমন এক সনদের ভিত্তিতে যা শান্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী যুদ্ধকে অনুমোদন করে। আরব-ইসরায়েল সংঘাত সব সময়ই এ ধরনের সন্ত্রাসী এজেন্ডার জন্য একটি সুবিধাজনক হাতিয়ার — প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য নয়, বরং এক আন্তর্জাতিক ইন্তিফাদা উস্কে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য।
কিন্তু এই হামলাগুলোর ফল উল্টো হয়েছে-রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা এই প্রশ্নে এক হয়েছে। হাউজ মাইনরিটি লিডার হাকিম জেফ্রিজ (ডি-এনওয়াই) এবং রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান গ্যাব এভান্স (আর-কলোরাডো) একবাক্যে বলেছেন, “ইহুদিবিদ্বেষকে দমন করতে হবে।” টেক্সাসের কংগ্রেসম্যান অগাস্ট ফ্লুগার, যিনি কাউন্টারটেররিজম ও ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কিত উপকমিটির চেয়ার, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী হামলার বৃদ্ধির বিষয়ে শুনানির ঘোষণা দিয়েছেন।
এই বহু পুরনো বিভ্রম-যে বৈশ্বিক সন্ত্রাস ফিলিস্তিনের পক্ষে কাজ করে-এক আত্মঘাতী কৌশল, যা কারও উপকারে আসে না, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের নয়। ২০শ শতকে এই শিক্ষা রক্তাক্তভাবে পাওয়া গেছে। ২১শ শতকে তা যেন আবার নতুন করে না শেখা লাগে।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম