ছাবেদ সাথী
রমজান সম্পর্কে অল্প পরিচিত কারও কাছে এটি অদ্ভুত মনে হতে পারে যে এই ইতিমধ্যেই কঠিন মাসের শেষ পর্যায়ে এসে মুসলিমরা ইচ্ছাকৃতভাবে আরও কঠিন করে তোলেন।
রমজানের প্রথম ২০ দিনে আমরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করি, খাদ্য, পানীয় এবং শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকি। এটি প্রতিদিন ইচ্ছাশক্তির একটি পরীক্ষা। কিন্তু শেষ ১০ রাতে, আরেকটি সংগ্রাম শুরু হয়, যা অনেকের জন্য আরও কঠিন: আমরা ঘুম ত্যাগ করি।
এই শেষ ১০ দিনের চূড়ান্ত মুহূর্ত আসে ২৭তম রাতে—এই বছর, যুক্তরাষ্ট্রে এটি পড়েছে বুধবার (২৬ মার্চ)। এই রাতটি স্মরণ করা হয় সেই পবিত্র মুহূর্ত হিসেবে, যখন ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে কুরআনের প্রথম আয়াত নাজিল করেন। এটি বিশ্বের বহু মুসলিমদের জন্য গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত, যা লাইলাতুল কদর বা “ভাগ্যরজনী” নামে পরিচিত। যদিও এই রাতের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা যায় না, তবে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, লাইলাতুল কদরের রাতে মসজিদগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম এই রাতে তাদের বিছানা ছেড়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়, নিরবতার মাঝে শাশ্বত কিছু খুঁজতে ব্যস্ত থাকে।
একটি রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ
কুরআনে লাইলাতুল কদরকে বর্ণনা করা হয়েছে “হাজার মাসের চেয়েও উত্তম” বলে। এটি সেই রাত, যখন মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, যখন আসমান ও জমিনের মধ্যে দূরত্ব যেন সবচেয়ে কম অনুভূত হয়, যখন রহমত প্রবাহিত হয়, এবং অন্তর তার আসল গন্তব্যে ফিরে যেতে পারে।
এই ১০ রাতে কিছু গভীর ও রহস্যময় কিছু ঘটে। বিশ্বজুড়ে, মসজিদে ও ঘরে, শহরে ও শরণার্থী শিবিরে, মুসলিমরা জেগে থাকে। কেউ চুপচাপ নামাজে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কুরআন তিলাওয়াত করে যতক্ষণ না চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে, কেউ লম্বা রাকাতে দাঁড়িয়ে একের পর এক সূরা পড়তে থাকে, যেখানে মাঝে মাঝে শুধু একটি “আমীন” শব্দই নীরবতা ভেঙে দেয়। আর কেউ কেউ কাঁদে—শুধু ক্লান্তির কারণে নয়, বরং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা থেকে।
ঘুম ছেড়ে জাগ্রত থাকা: আত্মসমর্পণের এক নতুন রূপ
দিনের বেলা ক্ষুধা ও তৃষ্ণার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন এক ধরনের শক্তি। কিন্তু যখন শরীর সম্পূর্ণ ক্লান্ত, যখন প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঘুমের জন্য আকুল, তখন জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া এক ভিন্ন শক্তি। এটি শুধু শারীরিক চাহিদা পরিত্যাগ নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত রূপ। এটি আসলে ইবাদতের সবচেয়ে খাঁটি রূপ—যেখানে কোনো জবরদস্তি নেই, কোনো প্রদর্শন নেই, শুধু নিখাদ ভক্তি আছে।
অনেকে বিশ্বাস করে যে ধর্ম কেবল শান্তি দেওয়ার জন্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বাস প্রায়ই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। ইসলামেও, এই শেষ রাতগুলো আমাদের সেই আত্মত্যাগের আহ্বান জানায়—আরাম ছেড়ে প্রকৃত প্রশান্তি খোঁজার জন্য।
যারা তাদের বিছানা ত্যাগ করে
কুরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা তাদের বিছানা ত্যাগ করে, তারা ভয়ে ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকতে থাকে।” এটি একটি নীরব কিন্তু গভীর শক্তিশালী দৃশ্য।
ঘুম ত্যাগ করা মানে নিজের শেষ ইচ্ছাটুকু পরিত্যাগ করা। যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজে জেগে থাকা মানে নিজের মধ্যে আরও কিছু মহৎ কিছু জন্মানোর জন্য জায়গা তৈরি করা। এবং হ্যাঁ, এটি ক্লান্তিকর।
অনেক রাতে শরীর বিদ্রোহ করে। নামাজ শুরু করলে মনে হয়, কীভাবে সম্পন্ন করবেন? পিঠ ব্যথা করে, চোখ জ্বালা করে, বিছানা যেন হাতছানি দেয়। কিন্তু কোনোভাবে আপনি চালিয়ে যান, আর সেই মুহূর্তেই কিছু পরিবর্তন ঘটে। আপনি বুঝতে পারেন যে রাতের এই নীরবতা, দিনের কোলাহলের চেয়ে আলাদা। এটি এক স্বচ্ছতা, এক নিবিড়তা, এক ঈশ্বরীয় সান্নিধ্যের অনুভূতি।
যা আমাদের ধরে রাখে, তা খাবার বা ঘুম নয়
সে মুহূর্তে আপনি উপলব্ধি করেন যে, আপনাকে ধরে রাখার শক্তি শুধুমাত্র খাবার, পানি বা ঘুম নয়। এটি সম্পূর্ণ অন্য কিছু। রমজান মুসলিমদের জন্য শুধুমাত্র সংযমের মাস নয়; এটি আত্মমুক্তির মাস—নিজের প্রবৃত্তি, মনোযোগ বিভ্রান্তকারী বস্তু ও আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। প্রথম ২০ দিনে আমরা শৃঙ্খলা শিখি, আর শেষ ১০ দিনে আমরা শিখি “সর্ম্পূণ আত্মসমর্পণ,” যা আরবি ভাষায় “ইসলাম” শব্দের প্রকৃত অর্থ।
আর আত্মসমর্পণ কখনো নিষ্ক্রিয় কিছু নয়, এটি বরং এক রূপান্তরকারী শক্তি।
শেষ কথা
তাই, যদি আপনি রমজানের ২৭তম রাতে ক্লান্ত, নিস্তেজ কিছু মুসলিমকে দেখেন, তাহলে বুঝবেন যে এটি শুধু শারীরিক অবসাদ নয়। এটি আত্মার পরিশ্রমের চিহ্ন। এটি সেই মুহূর্ত, যখন মানুষ দুনিয়ার ঊর্ধ্বে উঠে কিছু শাশ্বত সত্য খুঁজতে চেষ্টা করে।
ছাবেদ সাথী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবি, লেখক ও সাংবাদিক। সম্পাদক-বাংলা প্রেস
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম