Home কলাম এআই আইনি ব্যক্তিসত্তা পেলে মানুষের খেলা শেষ

এআই আইনি ব্যক্তিসত্তা পেলে মানুষের খেলা শেষ

by bnbanglapress
Published: Updated:
A+A-
Reset

 

ছাবেদ সাথী
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে আজকের আলোচনাগুলো প্রায়ই এক ধরনের ভুল আশঙ্কায় আটকে পড়ে-যেন এআই একদিন মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে যাবে, আমাদেরই বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। অথচ এআই প্রযুক্তি যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি আরও গভীর ও জরুরি একটি প্রশ্ন: এই সিস্টেমগুলো কোন আইনি কাঠামোর মধ্যে কাজ করবে?
আসল বিপদ হলো, এসব এআই সিস্টেম ধীরে ধীরে এমন সব অধিকার অর্জন করে নিতে পারে-যেমন সম্পত্তির মালিকানা, চুক্তিতে অংশগ্রহণ, বা আর্থিক সম্পদ ধারণ-যা একসময় তাদেরকে এমন এক অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবে, যাকে মানুষ আর সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এখনই যদি আইনগত সীমা টানা না হয়, তাহলে এআই এমন কাঠামো গড়ে তুলতে পারে, যা আমাদের সমাজের মৌলিক ভিত্তি—মালিকানা, দায়িত্ববোধ, এবং জবাবদিহি-কে বিকৃত করে দেবে।
২০১৫ সালে ডেটা অবকাঠামো উদ্যোক্তা পিটার রেইনহার্ড তাঁর প্রবন্ধ ‘এপিআই দিয়ে মিডল ম্যানেজমেন্ট প্রতিস্থাপন করা’ -এ সতর্ক করেন, প্রযুক্তির এই অগ্রগতি মানুষের কর্মক্ষেত্রে এক নতুন শ্রেণি বিভাজন তৈরি করছে-‘এপিআই-র ওপরে’ যারা, অর্থাৎ যারা নিয়ন্ত্রণ করে, এবং ‘এপিআই-র নিচে’ যারা, মানে যারা সফটওয়্যারের নির্দেশে কাজ করে। উবার চালকদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালকেরা কেবল একটি স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ব্যবস্থার অংশ-তাদেরকে যে কোনো সময় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, এমনকি ভবিষ্যতে চালকবিহীন গাড়ির দ্বারাও।
এই পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তির বাইরেও বড় একটি প্রশ্ন তোলে—আইন ও ক্ষমতার এমন এক জগৎ, যেখানে এআই হয়তো নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কিন্তু জবাবদিহির আওতায় আসবে না।
এমন আশঙ্কা ইতোমধ্যেই বাস্তব হয়েছে। গবেষক স্টিফেন থালার ২০১৯ সালে একটি পেটেন্ট আবেদনে দাবি করেন, তাঁর এআই সিস্টেম ‘ডাবুস’ নিজে থেকেই নতুন উদ্ভাবনের নকশা করেছে এবং তাকে উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার আদালত এই দাবিকে খারিজ করে দেন, বলে দেন-আইন অনুযায়ী উদ্ভাবক হতে হলে মানুষই হতে হবে। একই বছর, থালার তাঁর অন্য এআই ‘সৃজনশীলতা মেশিন’-এর তৈরি একটি শিল্পকর্মের কপিরাইট আবেদন করেন, যা মার্কিন কপিরাইট অফিস এবং পরে আদালত প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, কপিরাইটও মানুষের সৃষ্টি হতে হবে।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, এআই-কে আইনি অধিকার দেওয়ার চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। যদি এখনই সীমানা নির্ধারণ না করি, ভবিষ্যতে এই প্রচেষ্টা সফল হয়ে যেতে পারে।
এখানে একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে ১৮৭১ সালের সিভিল রাইটস অ্যাক্ট। মুক্ত দাসদের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রণীত এই আইন বলেছিল, একজন ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে কী কী অধিকার পাবে—যেমন সম্পত্তি রাখা, চুক্তি করা, নাগরিক জীবনে অংশ নেওয়া। আজ এই ইতিহাসই আমাদের পথ দেখাতে পারে, কোন অধিকারগুলো এআই সিস্টেমের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিত।
অবশ্যই, এই তুলনা ইতিহাসের গুরুত্বকে ছোট করে দেখানোর জন্য নয়। বরং এটি বুঝিয়ে দেয়, যেহেতু এআই একটি অমানবিক সত্তা, তাই তাদের এমন অধিকার পাওয়া উচিত নয়, যা কেবল মানুষের জন্য সংরক্ষিত।
অনেকে বলবেন, কর্পোরেশনও তো কৃত্রিম সত্তা, তাদেরও তো বহু আইনি অধিকার আছে। কিন্তু কর্পোরেশন শেষ পর্যন্ত মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত। এআই সিস্টেম তেমন নয়—তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পদ, প্রভাব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে—কোনো মানুষের জবাবদিহি ছাড়াই। যদি তা হয়, তাহলে এআই আমাদের আইন ও অর্থনীতির ভিত্তিকে এমনভাবে রূপান্তরিত করতে পারে, যা একেবারেই অমানবিক।
সমাধান একটাই-এআই সিস্টেম যেন কখনোই সম্পত্তির মালিক হতে না পারে, চুক্তি করতে না পারে, আর্থিক সম্পদ রাখতে না পারে কিংবা আদালতে পক্ষ হতে না পারে। এই বিধিনিষেধ উদ্ভাবনের পথে বাধা নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক আইনব্যবস্থার রক্ষাকবচ।
কারণ আইন যখন প্রযুক্তির পেছনে পড়ে থাকে, তখন একদিন আজকের অসম্ভবও কালকের বাস্তবতা হয়ে ওঠে। এখনই যদি এই সীমারেখা না টানি, ভবিষ্যতে তা আর সহজে টানা যাবে না।
এখনই সময়, প্রশ্ন তোলার: এআই সিস্টেম কী করতে পারবে—আর কী পারবে না?
না হলে, একদিন আমাদেরই তৈরি আইনি কাঠামো, মানুষ আর মেশিনের মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে, আমাদের সেই স্বাধীনতা ও অধিকারগুলোকে খেয়ে ফেলবে—যেগুলোর জন্যই আইন তৈরি হয়েছিল। আর তখন, আমরা সবাই হয়তো স্থায়ীভাবে নেমে যাব-এপিআই-র নিচে।

ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক। সম্পাদক বাংলা প্রেস

[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

বিপি।এসএম

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী