Home কলাম ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ খুলে দিতে পারে?

ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ কি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ খুলে দিতে পারে?

by bnbanglapress
Published: Updated:
A+A-
Reset

 

ছাবেদ সাথী
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গোপন উদ্দেশ্য, অনিচ্ছাকৃত ফলাফল এবং অপ্রত্যাশিত মোড়—এসবই নিয়ম, ব্যতিক্রম নয়। এই বাস্তবতা থেকেই বলা যায়, ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলি গোয়েন্দা ব্যর্থতা, যেটি এক ভয়াবহ হামলার জন্ম দেয়, তা হয়তো শেষ পর্যন্ত ইরানের পরমাণু উচ্চাশার অবসান ঘটিয়ে অঞ্চলজুড়ে অগ্রগতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, এমনকি গাজা সংকটেরও পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে।
ইসরায়েলের ইরান আক্রমণকে অন্তত দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। সমালোচকরা বলবেন—ইসরায়েল তাদের গোয়েন্দা তথ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় কিংবা প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ নয়। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু—যিনি নিজেই দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত—রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধ ব্যবহার করছেন এবং কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নন।
অন্যদিকে, অনেকেই বলছেন, ইসরায়েল একটি ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমন এক হুমকি নিরস্ত্র করতে চাচ্ছে, যেটি পশ্চিমা শক্তিগুলো বছরের পর বছর অবহেলা করে এসেছে।
দশকের পর দশক ধরে ইরানের ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠী বেসামরিক জ্বালানির ছদ্মাবরণে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে, একদিকে সন্ত্রাসে অর্থায়ন, অন্যদিকে প্রক্সি যুদ্ধে দেশব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। হিজবুল্লাহ লেবাননকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে অবাঞ্ছিত সংঘাতে জড়িয়েছে, সিরিয়ায় খুনে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে; হুথিরা ইয়েমেনে ৪ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী, সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং মিশরের সুয়েজ খালের আয়ে ধস নামিয়েছে। ইরাকের ওপর শিয়া মিলিশিয়াদের প্রভাব আর হামাসের ১২০০ ইসরায়েলি হত্যার ঘটনা এক ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করেছে, যার মূল্য চরমভাবে দিয়েছে গাজা।
ইরানের ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ—যা কার্যত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে—এর পেছনে কোনো বেসামরিক ব্যাখ্যা নেই। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাছাড়া ইসরায়েলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার ইরানি হুমকিকে আতঙ্ক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই বাস্তবতায় ইসরায়েল চূড়ান্ত কৌশলগত দক্ষতায় অভিযান পরিচালনা করছে। তারা ইরানের আকাশসীমায় দখল নিয়েছে, পরমাণু অবকাঠামো ধ্বংস করেছে, ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বিপর্যস্ত করেছে এবং উচ্চপদস্থ ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে।
এই সাফল্য এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ট্রাম্প প্রশাসনও এখন আর আগের মতো ‘প্লসিবল ডিনায়াল’ অবস্থানে নেই। ট্রাম্প হয়তো এই সফল অভিযানের কৃতিত্ব দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে দিতে পারেন। সম্ভাব্য একটি পদক্ষেপ হতে পারে ইরানের গভীরতম পারমাণবিক কেন্দ্র ফরদোর ওপর ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বান্কার বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ, যা কেবল আমেরিকানদের কাছেই আছে।
তবে এর ফলে যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে—ইরান মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে, ইসরায়েলে বড় রকমের প্রাণহানির ঘটনা সংঘটিত হতে পারে। আবার, এই পদক্ষেপ যুদ্ধ শেষ করে ‘বিজয়’ ঘোষণা করার সুযোগও এনে দিতে পারে।
অন্যদিকে, কূটনৈতিক পথও উন্মুক্ত রয়েছে। ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে তারা আলোচনায় আগ্রহী—এবার হয়তো দুর্বল অবস্থান থেকে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিগুলোর মধ্যে থাকবে ইউরেনিয়াম মজুত হস্তান্তর, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ইতি এবং আরব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের অবসান।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো—এই প্রেক্ষাপটে ইরানের ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার পতনের সম্ভাবনা। এটি হয়তো গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, বরং সামরিক বা গোয়েন্দা বাহিনীর ‘প্যালেস কুপ’-এর মাধ্যমে হতে পারে, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে রোমানিয়ায় বা ২০১১ সালে মিশরে। এই সম্ভাবনা এখনো শক্তিশালী না হলেও, যুদ্ধ দীর্ঘ হলে কিংবা ইরান আত্মসমর্পণ করলে তা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। যদি সত্যিই ইরান এভাবে নিঃশেষ হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক বিপ্লব ঘটবে।
একদিকে, ‘অক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নামের প্রতিরোধ জোটের অবসান ঘটবে। লেবানন নতুন সরকার গঠন করেছে, যারা হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে আগ্রহী। ইরানের সমর্থন ছাড়া হিজবুল্লাহ আর টিকে থাকতে পারবে না। ফলে আরব উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বড় অঙ্কের সহায়তা পাওয়ার পথ খুলবে।
ইরাক শিয়া মিলিশিয়াদের প্রভাবমুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় অগ্রসর হতে পারবে। ইয়েমেনে হুথিদের দখল থেকে ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের অভিযান জোরদার হবে, যার ফলে সুয়েজের বাণিজ্য চলাচলও স্বাভাবিক হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারে গাজায়। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, তাদের অনেকেই বেসামরিক নাগরিক। হামাস এখনো কিছুটা টিকে থাকলেও, যদি তারা ইরানের সমর্থন হারায়, তাহলে আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। মিশর, সৌদি আরব, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার—সমন্বিতভাবে হামাসকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে, এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে পারে। আরব নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে মোতায়েন করা যেতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে ইসরায়েলকেও চাপ প্রয়োগ করতে হবে। নেতানিয়াহু এতদিন তাঁর ডানপন্থী জোট টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই ধরনের উদ্যোগে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ইরানে সাফল্যের পর রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ থাকলে নেতানিয়াহুরও সহযোগিতা করতে হবে। এবং অধিকাংশ ইসরায়েলি জনগণ যুদ্ধের অবসান ও বন্দিদের মুক্তি চায়।
এই নতুন বাস্তবতায় আব্রাহাম চুক্তির সম্প্রসারণের পথও খুলে যেতে পারে। ইরানের ভীতি কমলে সৌদি আরব ও এমনকি সিরিয়াও এতে যোগ দিতে পারে। সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব, যাদের পরিচিতি ‘সাবেক জিহাদিস্ট’ হিসেবে, তারা বৈশ্বিক বৈধতা এবং বিনিয়োগ চায়। ইতিমধ্যে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগের ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই পটভূমিতে নেতানিয়াহু হয়তো নতুন নির্বাচনে আবারও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেন। ইতিহাসে বহুবার কঠোর অবস্থানের নেতারা মত পরিবর্তন করে শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন—নিক্সনের চীন সফর, ডি ক্লার্কের বর্ণবাদের অবসান, সাদাতের জেরুজালেম ভ্রমণ—সবই উদাহরণ।
আর ট্রাম্প? হয়তো তিনিই একদিন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার জিতে নেবেন—যদিও সেই শান্তি সূচনা হয়েছিল হামাসের এক ভয়াবহ গণহত্যা দিয়ে। সেটাই হবে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ফলাফল।

ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।

[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

বিপি।এসএম

 

You may also like

Leave a Comment

banglapress24

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

১১১ শেলডন রোড # ১৮৮৪, ম্যানচেস্টার, কানেকটিকাট ০৬০৪২

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৫ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী