ছাবেদ সাথী
যখন ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করল, তখন ‘শাসন পরিবর্তনের’ গুঞ্জন যেন চিৎকারে রূপ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখন প্রকাশ্যে আলোচনায় আনছেন আয়াতোল্লাহ আলি খামেনিকে সরানোর সম্ভাবনা। পশ্চিমা মিডিয়া, যথারীতি, তাতে উৎসাহী। মতামত লেখকরা বলছেন ‘মুক্তি’, ‘স্বাধীনতা’, ‘নতুন গণতান্ত্রিক সূচনা’। কিন্তু তাদের আরও ভালো জানা উচিত। আমাদের সবারই।
এটাই প্রথম নয়, যখন আমেরিকা তেহরানে সরকার পতনে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫৩ সালে, সিআইএর সহায়তায় ক্ষমতা থেকে সরানো হয় ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে— কারণ তিনি ইরানের তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন। তার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আসে শাহের শাসন—একজন স্বৈরশাসক যিনি ভিন্নমতাবলম্বীদের গুপ্তচর বাহিনী সাভাকের হাতে তুলে দিতেন।
নির্যাতনকক্ষ, নিখোঁজ, সেন্সরশিপ—যুদ্ধকালীন স্বৈরতন্ত্রের সম্পূর্ণ পাঠ্যবই যেন ইরানে তুলে দেওয়া হয়েছিল মার্কিন সরকারের লেটারহেডে। এই শাসন পরিবর্তন মুক্তি নয়, বরং নিয়ে আসে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব। বলাই যায়, আগেরবার আমেরিকার হস্তক্ষেপ এক সেক্যুলার গণতন্ত্রকে রূপ দিয়েছিল ধর্মীয় চুল্লিতে। আমরা এই ভুল আগেও করেছি, এবং আবার করতে যাচ্ছি।
চলুন, স্বপ্ন না দেখে বাস্তব বলি—ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পতন কোনো ‘ইনস্টাগ্রাম ফিল্টার দেওয়া উদারপন্থী স্বর্গ’ আনবে না। এই কল্পনা তাদের জন্য, যারা ‘ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’ ম্যাগাজিনকে ‘মার্ভেল’ কমিকের মতো পড়ে। বাস্তবতা হলো: বিশৃঙ্খলা। গভীর, গোষ্ঠীগত, সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা। একধরনের শক্তি-শূন্যতা, যেটা ইরাককেও যুক্তিযুক্ত দেখাবে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে, শুধু একটি সরকার নয়, একটি জটিল আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের মাকড়সা-নেতাকেও সরিয়ে দেওয়া হবে। লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুথি, ইরাক-সিরিয়ায় শিয়া মিলিশিয়া—এই মাকড়সা মরলে এর জালও ছিন্ন হবে। কিন্তু তারা কি গুটিয়ে নেবে? বরং, আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। স্বতন্ত্র, অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে তারা। তারা ‘শান্তি আলোচনা’ করবে না, বরং গোটা মানচিত্র পুড়িয়ে দেবে।
এরা কিন্তু এলোমেলো গেরিলা নয়। তারা সুশৃঙ্খল, যুদ্ধ-কঠোর, এবং আদর্শিকভাবে একনিষ্ঠ। তেহরান না থাকলে তারা মুক্ত হয়ে যাবে, কিন্তু উদ্দেশ্যবিহীন নয়—বরং পুরোনো প্রতিশোধের আগুনে আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে।
আর ইসলামি রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)? তারা কি বিদায় জানাবে? মোটেই না। তারা একটি রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র—নিজস্ব সেনাবাহিনী, অর্থনীতি, মতাদর্শ নিয়ে। বন্দর, ব্যাংক, তেলক্ষেত্র চালায় তারা। ছোট ছোট রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখে। এই আদর্শিক যোদ্ধারা পরিণত হবে একেকটি ক্ষুদ্র রাজ্যে। ভাবুন, তেল-সমৃদ্ধ তালেবান।
আর তারা গৃহবন্দি হয়ে থাকেও না—তারা বিশৃঙ্খলা রপ্তানি করে। এখন কল্পনা করুন, দশটি ভিন্ন আইআরজিসি উপদল, যারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে দেশের পরিকাঠামো দখলের লড়াইয়ে নামবে। এ মুক্তি নয়। এ এক নতুন মোগাদিশু, সম্ভবত পরমাণু অস্ত্রসহ।
এবার ভাবুন, পরমাণু হুমকি। যদি ইরান ভেঙে পড়ে, তার পারমাণবিক উপাদান কোথায় যাবে? বিশৃঙ্খল বাজারে বিক্রি হতে থাকবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুঁজে পাবে না, কারণ এরই মধ্যে তা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আপনি যদি আইসিসের বোমা খারাপ ভাবেন, তবে ভাবুন—হিজবুল্লাহ যদি পায় ছোট্ট একটি পারমাণবিক ডিভাইস? কিংবা একজন যুদ্ধপ্রভু যদি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে পরিচিতি গড়তে চায়?
এই ‘মুক্ত’ ইরান হতে পারে এক ডজন ব্যর্থ ক্ষুদ্র-গণতন্ত্রের জন্মদাতা, যাদের প্রত্যেকেরই আলাদা পতাকা, আক্রোশ এবং প্রতিশোধের খিদে থাকবে।
আর যুক্তরাষ্ট্র? যতবার তারা ‘শাসন পরিবর্তনের’ স্বপ্ন দেখে, ততবার শহর ধ্বংস হয়, ঠিকাদাররা চুক্তি পায়, আর শিশুরা মরুভূমিতে মৃত্যু বরণ করে। লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান—আর কতবার আমরা শিখব? আর কতটা দেশ জ্বালিয়ে দিয়ে বোঝব, আমরা গণতন্ত্রের রপ্তানিকারক নই—আমরা স্মার্ট স্যুট পরা অগ্নিসংযোগকারী?
আর এই আগুন লাগানো মানুষগুলো পরে আর পানি আনেন না—তারা প্রেস কনফারেন্স করেন।
বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব কী? সৌদি আরব প্রভাব বাড়াবে, তুরস্ক তাকিয়ে থাকবে উত্তর ইরানের দিকে। গালফ স্টেটগুলো, যারা আগে থেকেই ভীত, আরও গোপন বাহিনী গড়বে। সুন্নি-শিয়া বিভাজন ঘুচবে না—বরং জ্বলবে।
ঠান্ডা যুদ্ধ নয়, এটি হবে ধর্মীয় আগুনে ঘেরা যুদ্ধক্ষেত্র। ট্যাঙ্কধারী গোষ্ঠী, ড্রোনধারী জাতীয়তাবাদী বাহিনী, রিফিউজি স্রোত—সিরিয়ার থেকেও ভয়াবহ।
আর ইরানের জনগণ? যারা নারী অধিকারের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য পথে নেমেছিল—তারা পড়ে থাকবে চাপা পড়ে—নতুন-পুরোনো শাসনের পেষণে। তাদের হত্যা করা হবে, আর মনে রাখা হবে না।
সত্যটি কঠিন, কিন্তু বলা দরকার: খামেনির পতন ইরানকে মুক্ত করবে না। তাকে অস্থিতিশীল করবে। এটি শেষাংশ নয়, বরং আরও নির্মম এক যাত্রার সূচনা।
আর ৯ কোটি মানুষের একটি দেশ, যার আছে ব্যালিস্টিক মিসাইল, আঞ্চলিক প্রভাব—তার গৃহযুদ্ধ কোনো ‘ফুটনোট’ হবে না—এটি হবে বৈশ্বিক সঙ্কট।
পশ্চিমা বিশ্বকে আর একটি ‘শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন’ দরকার নেই। দরকার ‘চিন্তার পরিবর্তন’। আমরা বিশ্বকে নিজের মতো গড়ার চেষ্টা করছি ড্রোন দিয়ে—আর তার ফলাফল পড়ছে রিফিউজি শিবির আর পোড়া শহর। এটা শুধু ঔদ্ধত্য নয়, এটা মানবতার ছদ্মবেশে গণহত্যা।
আর যারা মরবে, তারা খামেনি নয়। তারা হবে—চিকিৎসক, দোকানদার, ব্যাকপ্যাক হাতে ছোট্ট শিশু। ইরান যদি পড়ে, তার জায়গায় উঠবে না স্বাধীনতা।
উঠবে আগুন। এবং সেই আগুনে আগুন জ্বালাব আমরাই।
ছাবেদ সাথী: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক বাংলা প্রেস।
[বাংলা প্রেস বিশ্বব্যাপী মুক্তচিন্তার একটি সংবাদমাধ্যম। স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য নিরপেক্ষ খবর, বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজ আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]
বিপি।এসএম