নরসিংদী প্রতিনিধি : নরসিংদীতে সুমন মিয়া নামে ৩ তিন সন্তানের এক জনককে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছে নিহতের পরিবার। বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) নরসিংদীর পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা এলাকায় এ হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। নিহত সুমন মিয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার উপজেলার গোপালদী বাজার এলাকার মৃত সনু মিয়ার ছেলে এবং শিবপুর উপজেলার সাধারচর ইউনিয়নের চরখুপি এলাকার জামাই। নিহতের ৭ বছর, ৪ বছর এবং ১ মাস বয়সের তিনটি ছেলে সন্তান রয়েছে। স্বামীকে হারিয়ে অবুঝ তিন সন্তানকে নিয়ে হতাশার অন্ধকারে ডুবে আছেন স্ত্রী ফাহিমা বেগম।
জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত আটটার দিকে সুমন তার শ্বশুর বাড়ি চরখুপি হতে গোপালদীর উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গাড়ি না পেয়ে গাড়ি পাওয়ার আশায় পায়ে হেঁটে রাত নয়টার দিকে পলাশের মালিতা এলাকায় পৌঁছলে প্রচন্ড বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। এসময় সুমন পাশ্ববর্তী একটি দোকানের চালার নীচে আশ্রয় নিলে সেখানের লোকজন চোর সন্দেহে তাকে আটকের বেদম মারধর করে। পরের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে সুমনকে আটককৃত দোকান থেকে প্রায় তিনশত গজ দূরে রাস্তার পাশে একটি মেহগনি গাছের সাথে নীজের গায়ের শার্ট দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
সরেজমিনে গত শনিবার ৫ অক্টোবর পলাশের মালিতা এলাকার নিহত সুমনকে ওই রাতে যে বাড়িতে আটক করা হয়েছিল সেখানে গেলে পাশ্ববর্তী পাঁচ-সাতটি বাড়ি পুরো জনমানবশূন্য এবং তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পুরো এলোকা জনমানবশূন্য এবং তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এছাড়াও সুমনকে কথিত যে গাছে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে সেই গাছতো দূরের কথা তার কোন চিহ্ন ও রাখা হয়নি। গাছপালা সব কেটে গাছের মূলসহ তুলে ফেলে সমস্ত আলামত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
এসময় বাড়ির মালিক এজাজুল ও লিটনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মাসুদা আক্তারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন রাতে এক ব্যক্তিকে তার ভাসুর এজাজুল, লিটন ও আরও কিছু লোকজন চোর সন্দেহে আটক করে। পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাকে ছেড়ে দিতে বললে আমরা তাকে ছেড়ে দেই। পরদিন সকাল বেলা শুনি ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে।
নিহত সুমনের স্ত্রীর বড় ভাই (সুমুন্দী) জামাল মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১ টার দিকে সুমনের মৃত্যুর খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। এসে দেখি আমার ভগ্নিপতির নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। তার ডান পা ভাঙ্গা, হাঁটুর নীচে আঘাতের চিহ্ন, মুখের কয়েকটি দাঁত ভাঙ্গা। আলামত দেখে কোনভাবেই এটিকে আত্মহত্যা বলা যায় না। তারা আমার ভগ্নিপতিকে হত্যা করে টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত পলাশ থানা পুলিশের এসআই মামুন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ছুটি থেকে এসে বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান। ছুটি শেষে গত বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) আমরা আমার ভগ্নিপতির মৃত্যুর তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসআই মামুন আমাদেরকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন।
এতে আমরা অস্বীকৃতি জানালে মামলায় আমরা উল্টো ফেঁসে যাব এবং আসামীরা আমাদের নামে মামলা দায়ের করবে বলে তিনি ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে স্বাক্ষর না করেই থানা থেকে চলে আসি। এব্যাপারে আদালতে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে মৃত্যুর আসল রহস্য উদঘাটন করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন জামাল।
চরসিন্দুর মধ্যপাড়া জামে মসজিদের সাবেক ইমাম ও পোল্ট্রি ফিড ব্যবসায়ী হাফেজ মাওলানা হাবিবুল্লাহ বলেন, রাতে যখন লিটন, এজাজুল ও তাদের বাড়ির লোকজন মিলে চোর সন্দেহে সুমনকে পিটায় তখন লিটন ও এজাজুল সুমনের পরিচয় নিশ্চিত হতে তাদেরই মামাতো ভাই চরসিন্দুর বাজারের গোশত ব্যবসায়ী (কসাই) ইব্রাহীমের নিকট ফোন করেন।
পরের দিন সুমনের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ইব্রাহিম আমাকে এবং মালিতা এলাকার ফারুক ভুঁইয়াকে একথা গুলো জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সুমন খুব শান্ত স্বভাবের ছেলে। সে কোনভাবেই আত্মহত্যা করতে পারেনা। তার লাশ দেখে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগবে যে একজন মানুষ তার শ্বশুর বাড়ি থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরে এসে কেন ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে ? আর আত্মহত্যাই যদি হয়ে থাকে তবে তার পা এবং দাঁত ভাঙ্গা কেন ? হত্যাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার ইউপি সদস্য ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে একটি হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে অভিযোগ করে অনতিবিলম্বে তদন্ত সাপেক্ষে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তিনি।
এব্যাপারে গোশত ব্যবসায়ী ইব্রাহীমের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রাত আনুমানিক সাড়ে বারোটার দিকে মালিতা থেকে আমার চাচার নিকট ফোন আসে। চাচা আমাকে ঘুম থেকে তুলে জামালের ভগ্নিপতি সুমনকে চিনি কিনা জানতে চায়। ঘটনা শুনে আমি মালিতায় ফোন করি। তারা সেখানে গাঁজাসহ সন্দেহজনক অবস্থায় দুইজনকে আটক করেছে বলে জানায়। তখন আটককৃতরা তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছে কিনা বা কোন কিছু নষ্ট করেছে কিনা জানতে চাইলে তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদেরকে রাস্তা থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানায়। এসময় মোবাইল ফোনে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে শোরগোল করার শব্দ শুনতে পাই। আমি আমার আত্মীয়দেরকে আটককৃত লোকেরা যেহেতু পাশ্ববর্তী এলাকার লোক তাই ছেড়ে দিতে বলি। কিন্তু তারা স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে আলাপ করে ছেড়ে দিবে বলে জানায়।
চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা এলাকার ইউপি সদস্য নাসির উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছে এব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,গত ১৫ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়া বইছিল। রাত পৌনে একটার দিকে মালিতা এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে লিটন, এজাজুলসহ আরো তিন-চার জন মহিলা আমাকে ফোন করে জানায় যে, তাদের বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে একজন মাতাল আটক করেছে। তখন আমি তাদেরকে উক্ত মাতাল ব্যাক্তিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে মোবাইল ফোন রেখে দেই। ১০ মিনিট পর পুনরায় ফোন করে লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তারা তাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে জানায়।
পরদিন সকাল সোয়া সাতটার দিকে একটি লোক ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে মর্মে এক মহিলা আমাকে ফোন করে। আমি তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ উদ্ধার করে।
মালিতা এলাকার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লাল মিয়ার ছেলে এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বাবুল মিয়া বলেন, এলাকার লোক হিসেবে তারা অনেক কিছুই গোপন করে গেছে। তবে পুলিশ অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন সিজ করে সেদিন রাতে তাদের মোবাইল কললিস্টগুলো যাচাই-বাছাই করে আইনের আওতায় আনা হলেই আসল রহস্য উন্মোচন হবে। একটি হত্যাকান্ডকে কোনভাবেই সমর্থ করা যায় না। তদন্ত সাপেক্ষে এর দ্রুত বিচার হওয়া দরকার।
যে গাছে সুমনে লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায় সে গাছের মালিক প্রবাসী আসাদ ভুঁইয়ার বোন রহিমা বেগম বলেন, ‘আমি সকাল ৭ টার দিকে ছাই ফেলতে গিয়ে গাছে লাশ ঝুলতে দেখে ডাকচিৎকার শুরু করি।।
প্রবাসী আসাদ ভুঁইয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগমের নিকট গাছ পালা কেটে আলামত নষ্ট করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ আমাদেরকে গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে ফেলতে বলেছে। তাছাড়া এই গাছে নাকি আরও লোক ফাঁসি নিতে পারে বলে এলাকাবাসী ভয় দেখিয়েছে তাই আমরা গাছ কেটে ফেলেছি। তবে এটি যদি প্রকৃতপক্ষেই হত্যাকান্ড হয়ে থাকে তাহলে সুষ্ঠু তদন্তে এর কঠোর বিচার দাবি করেন তিনি।
পলাশ থানার এসআই এবং অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুন তার উপর আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি তাদেরকে কোন ধরনের কাগজে স্বাক্ষর করতে বলিনি।’ পরে অবশ্য সিজার লিষ্টের কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেছেন বলে স্বীকার করেন।
পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াস বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করে ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে লাশ প্রেরণ করি। ময়নাতদন্তের পর নিহতের আত্মহত্যার বিষয়ে রিপোর্ট এসেছে। এছাড়া পিবিআই ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বলেও জানান তিনি। বিষয়টি তিনি আরও খতিয়ে দেখবেন বলেও সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন।
বিপি/কেজে