বাংলাপ্রেস ডেস্ক: নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ইউপি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য শালীনতা বহির্ভূত- এমন কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।
নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্যের উচিত নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সহযোগিতা করা। কিন্তু সেই জায়গায় বসে এমন সব মন্তব্য কাম্য নয়। তাছাড়া তিনি এমন সব কথা মাঝে মাঝে বলেই থাকেন। তাই তার অনুপস্থিতিতে তার বিষয়ে কথা বলাও ঠিক নয়- বলেন সিইসি।
সোমবার (১৫ নভেম্বর) বিকেল ৪টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি মৃত্যুও স্বাভাবিক না। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছি, নির্বাচনী এলাকায় যারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সহিংসতা করে তাদের রোধ করতে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে।
তিনি বলেন, আমাদের জায়গা থেকে শতভাগ পাওয়ার (ক্ষমতা) প্রয়োগ করতে পারছি। কিন্তু যারা মারামারি করছে সেটা আসলে তাদের ব্যাপার। তবে আমরা পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছি কেউ যদি নির্বাচনের সময় কোন সহিংসতা করে তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
সিইসি বলেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কোন কোন খবরে জনমানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আপনাদের মাধ্যমে কমিশনের বক্তব্য এবং অবস্থান দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে দেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১ম ধাপে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর ৩৬৯টি এবং ১১ নভেম্বর ২য় ধাপের ৮৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩য় ধাপে ২৮ নভেম্বর ২০০৭টি এবং ৪র্থ ধাপে ২৩ ডিসেম্বর ৮৪০টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া শিগগিরই ৫ম ধাপে আরো প্রায় ১০০০ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ বছরের মধ্যেই মেয়াদ উত্তীর্ণ সকল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা রয়েছে।
২য় ধাপে ৮৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮৪৭২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন পদে প্রার্থী ছিল ৪১ হাজার ২১৮ জন। মোট ১৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং ব্যাপক সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। চেয়ারম্যান পদের বিপরীতে ৩ হাজার ৩১০ প্রার্থী, সাধারণ সদস্য পদের বিপরীতে ২৮ হাজার ৭৪৭ এবং সংরক্ষিত আসন সদস্য পদের বিপরীতে ১ হাজার ১৬১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দেখা গেছে, প্রতি চেয়ারম্যান পদের বিপরীতে গড়ে ৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোট প্রদানের গড় হার ৭৪.২২%।
এখানে উল্লেখ্য, ২য় পর্যায়ে ৮৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ৮ হাজার ৪৭২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৬টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত হওয়ার কারণে বন্ধ করা হয়। যা মোট ভোটকেন্দ্রের মাত্র ০.১৮%। তারপরও ভোটকেন্দ্রের বাইরে বিচ্ছিন্ন হানাহানির ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে প্রাণহানিও হয়েছে- যা কাম্য নয়। উল্লেখ করা তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হয়েছে। টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং অবাধ নির্বাচনের খবর প্রচার করা হয়েছে। তাতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদানের সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে।
নূরুল হুদা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনাসহ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী মালামাল বিতরণ, ভোটগ্রহণ, ভোটগণনা, ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুচারুরূপে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রতি ধাপেই ভোট গ্রহণের দিন, এর আগে ও পরে ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী এলাকায় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া আচরণবিধি ভঙ্গসহ নির্বাচনী অপরাধের বিচারের জন্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। নির্বাচনী এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়।
নির্বাচনকে ঘিরে কয়েকটি স্থানে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তার কোনটাই প্রত্যাশিত ও কাম্য নয়। তবে এসব প্রাণহানির ঘটনার সবগুলো নির্বাচনী সংঘর্ষের কারণে হয়েছে কিনা তা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি ঘটনা ভোটকেন্দ্রে বা ভোটের দিন ঘটেছে। কোন ঘটনা তফসিল ঘোষণার আগেই ঘটেছে আবার কোনটা রাতের আধারে ঘটেছে- বলেন তিনি।
এবারের ইউপি নির্বাচনের সময়ে নরসিংদী জেলার রায়পুরের একটি দুর্গম চর এলাকায় হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নরসিংদীর ঘটনার বর্ণনায় প্রথম আলো উল্লেখ করেছে- ‘গত ১০ বছরে আধিপত্য বিস্তারের নামে নরসিংদী চরাঞ্চলগুলোতে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।’ (নরসিংদীতে কেন এত সহিংসতা, ১২ নভেম্বর ২০১১)। ওই এলাকায় এ মানের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ৪ নভেম্বর, নির্বাচনের ৫ দিন পূর্বে। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে নির্বাচনের দিন ভোরে নির্বাচন শুরু হওয়ার পূর্বে।
সম্প্রতি মাগুরার যে হতাহত হয়েছে তা নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের পূর্বে ঘটেছে। যা ছিল নিতান্তই এলাকার প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে। একইভাবে মেহেরপুরের গাংনির ঘটনার পেছনে বংশগত আধিপত্য বিস্তারই মূল কারণ বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। মেহেরপুরের ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনের দিন ভোর রাতে। সংঘর্ষ চলাকালে উচ্ছৃঙ্খল লোকজনকে দেশি অস্ত্রসহ মহড়া দিতে দেখা গেছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে দুই ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আরো দুই ধাপের নির্বাচনী কার্যক্রম চলছে। এরপর একাধিক ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সবগুলো নির্বাচন সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সুযোগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী তাদের সমর্থক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বোপরি সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ থাকবে; তারা যেন সবাই নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলেন, সহনশীল আচরণ করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন, ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, ইসির যুগ্ম-সচিব ও পরিচালক এম এম আসাদুজ্জামান।
বিপি/কেজে