গাইবান্ধা প্রতিনিধি: আদালতের আপিল মামলার রায়সহ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ অমান্য করে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের শিশুদহ বিল ইজারা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ অমান্য করার হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যাকডেটে উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা দেখিয়ে শিশুদহ বিল ইজারা প্রদান ও ইজারা চুক্তি সম্পাদনও করা হয়েছে। মামলা এবং পলাশবাড়ী উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) ইজারা প্রদান প্রক্রিয়ার সকল কাগজপত্র ঘেঁটে ইজারা প্রদান প্রক্রিয়াটিতে যে ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তা সহজেই প্রতিয়মান হচ্ছে।
এই এক শিশুদহ বিল নিয়ে এতোকিছুর পরও এখন প্রকৃত মালিকদের শিশুদহ বিল ভোগদখলে বাঁধা প্রদান করা হচ্ছে। এ নিয়ে গত ৯ নভেম্বর পলাশবাড়ীর ইউএনও এবং উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নোটিশ পাঠানো হয়েছে। মামলা সূত্রে জানা গেছে, পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের শিশুদহ গ্রামে ৪ একর ৪৬ শতাংশ জমি নিয়ে গঠিত শিশুদহ বিল। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই জমি যতি মামুদ, খতি মামুদ ও লতি মামুদের নামে এস/এ ৬ নং খতিয়ান প্রস্তুত হয়। তাদের ৩৬ জন অংশীদার এই জমি ভোগদখল ও খাজনা প্রদান করে আসছেন। কিন্তু ২০০০ সালে আবারও খাজনা জমা দিতে গেলে তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে এই জমি সরকারি খাস হিসেবে দাবি করে ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়।
এর প্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ৬ জুন শিশুদহ বিল নিজেদের দাবি করে পলাশবাড়ী সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন ৩৬ জন অংশীদার। যার নম্বর- ৪৮/২০০০। মামলায় জেলা প্রশাসক ও পলাশবাড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিবাদী করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল খারিজ করে দেন পলাশবাড়ী আদালত। এরপর একই সালের ২৬ জুন জেলা জজ আদালতে আপিল করেন বাদীরা। যার নম্বর- ৮২/২০০৮। এরপর ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মামলাটির দোতরফা সূত্রে রায় দেন অতিরিক্ত জেলা জজ
আদালত। রায়ে বাদীরা মালিকানা স্বত্ত¡ ও দখলকার এবং ১২ সেপ্টেম্বর ডিক্রিপ্রাপ্ত হন। তারপর থেকে এই ৩৬ জন অংশীদার এই শিশুদহ বিল নির্বিঘ্নে ভোগদখল করে আসছেন।
এ অবস্থায় শিশুদহ বিলের জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করার জন্য গাইবান্ধা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর মামলা দায়ের করেন এই অংশীদাররা। যার নম্বর- ১২২/১৪। পরে তারা মামলাটি পক্ষে রায় পান চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এদিকে, আপিল মামলার রায়কে অমান্য করে ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শিশুদহ বিলটিকে তিন বছরের জন্য জলমহাল ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেজবাউল হোসেন। যার স্মারক নং- ৩১.৫৫.৩২৬৭.০০০.০৬.০০১.১৯-২০৫। এর প্রেক্ষিতে একই সালের ১৯ মার্চ পলাশবাড়ী সহকারী জজ আদালতে জেলা প্রশাসক, পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিবাদী করে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মামলা দায়ের করেন ৩৬ জন অংশীদার। যার নম্বর-৪১/২০১৯।
একই দিন বিবাদীদের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন তারা। এরপর ২০ মার্চ বিবাদীদের ৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন আদালত। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা আদালতে উপস্থিত হননি এবং নোটিশের জবাবও দেননি। পরে ২১ এপ্রিল অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেওয়া হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার এই আদেশে বলা হয়- উপজেলা প্রশাসন যাতে এই শিশুদহ বিল ইজারা দিতে না পারে ও বাদীদের শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে বাঁধা দিতে না পারে। এই আদেশের নোটিশ ২৫ এপ্রিল গ্রহন করেন জেলা প্রশাসক ও ২৮ এপ্রিল গ্রহন করেন পলাশবাড়ীর ইউএনও এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
এরপর ২৯ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিশের আপত্তি দেন এই তিন বিবাদী। অপরদিকে, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ অমান্য করে তড়িঘড়ি করে ব্যাকডেটে ১৩ মার্চ উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা দেখিয়ে শিশুদহ বিল ইজারা দেখান তৎকালীন ইউএনও। সভায় বলা হয়, মনোহরপুরের বড় আজরা বিল, কিশোরগাড়ীর টেপুদহ বিল ও হোসেনপুরের শিশুদহ বিল নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ আদালতে চলমান মামলায় কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকা সাপেক্ষে এই জলমহাল ইজারা দেওয়া হয়। সভার সিদ্ধান্তে বিঃদ্রঃ হিসেবে লেখা রয়েছে, শিশুদহ বিল নিয়ে বিজ্ঞ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৪১/২০১৯ নম্বর মামলাটি চলমান রয়েছে এবং এতে ইজারা দেওয়ার বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা নাই।
প্রকৃতপক্ষে- চিরস্থায়ী ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মামলাটি দায়ের করা হয় ১৯ মার্চ। তাহলে ১৩ মার্চ ইউএনও কিভাবে জানলেন ৪১ নম্বর মামলা সম্পর্কে। তাহলে খুব সহজেই প্রতিয়মান হচ্ছে, আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার পরও বিল ইজারা দিয়ে আদালতের আদেশ অমান্য করার হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যাকডেটে ১৩ মার্চ উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা দেখিয়ে বিল ইজারা দেওয়া দেখানো হয়েছে। হোসেনপুর ইউনিয়ন মৎস্য সমবায় সমিতি প্রতিবছর ৭৫ হাজার টাকায় এই বিল ইজারা পান। অপরদিকে, ৯ মে ইজারা গ্রহীতাদের ১৬ মের মধ্যে ইজারার টাকা জমা দিয়ে ইজারা চুক্তি সম্পন্ন করতে বলেন তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফ হোসেন। যার স্মারক নং- ৩১.৫৫.৩২৬৭.০০০.০৬.০০১.১৯-৩৬৮। এখানেও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যাকডেটে ১৬ এপ্রিল ইউএনও মেজবাউল হোসেন ইজারা চুক্তি সম্পন্ন দেখান।
কেননা যেখানে ৯ মে ইজারা গ্রহীতাদের ১৬ মের মধ্যে ইজারার টাকা জমা দিয়ে ইজারা চুক্তি সম্পন্ন করতে বলেন, সেখানে কিভাবে ১৬ এপ্রিল ইজারা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে মর্মে দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে ইজারা চুক্তি সম্পন্নের তারিখ হবে ৯ মে বা তার পরে। শিশুদহ বিলের মালিকদের মধ্যে মো. শওকত আলী ও খাইরুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, পৈত্রিক সূত্রে পেয়ে আমরা শিশুদহ বিলে ধান ও মাছ চাষ করছি। কিন্তু আমাদেরকেই এখন বিলে যেতে বাধা ও বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। গত ৪ অক্টোবর পুলিশ পাঠিয়ে দিয়ে ডেকে পাঠান ইউএনও। মামলা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে চাইলে তা না দেখেই ইউএনও মাছ উত্তোলন করে বিলে আর মাছ ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছেন।
ফলে এখন সঠিকভাবে মাছের যত্ন করতে না পেরে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। বাঁধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে পলাশবাড়ীর বর্তমান ইউএনও মো.কামরুজ্জামান বলেন, যারা বিল ইজারা পেয়েছেন তারাই পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিল ইজারা আমার পূর্বের কর্মকর্তা দিয়েছেন, এ বিষয়ে কাগজ না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না। ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিলের প্রক্রিয়া চলমান আছে বলেও জানান ইউএনও।
বিপি/কেজে