১৩ অক্টোবর ২০২৫

ছোট গল্প: লজিং মাষ্টার

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
ছোট গল্প: লজিং মাষ্টার
সিকদার মনজিলুর রহমান: কাজলি, এই কাজলি, তোমার কী হয়েছে বল তো? বেলা দশটা বেজে গেল রুমের দরজা বন্ধ করে এখনও শুয়ে আছ যে শরীর খারাপ নাকি ? কাজলি এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্যা। সবচেয়ে আদরের। এমনিতে খুবই মিশুকে, আর আনন্দে থাকতে পছন্দ করে। রাগ বা অভিমান তার ধাতে নেই। তা এমন মানুষ যদি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে তা হলে কারই ভাল লাগে! রুমের ওদিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো কাজলির ভাবী মিনা । রুমের দরজা খুলে আতকে ওঠে মিনা । বিছানার ওপর পড়ে আছে আছে এক টুকরা চিরকুট , ‘ আই এ্যাম লুকিং ফর সালাম । আই ডোন্ট ওয়ান্ট মেরি এ্যানি ওয়ান এ্যালস । ইফ আই ডোন্ট ফাইন্ড হিম ।’ চিরকুটটি পেয়েই মিনা চিৎকার দিয়ে তার স্বামীকে ডাক দিলো, ও গো , শুনছ ? ওদিক থেকে জবাব এলো, কি ব্যাপার মিনা ? এই সাতসকালে ষাড়ের মত চিল্লাছ কেন ? তাড়াতাড়ি এদিকে এসো । কাজলি তার রুমে নাই, পালিয়েছে । বল কী ? বড় ভাই আব্দুল বাকি ছুটে এসে রুমে চিরকুটটি দেখে হতবাগ । শান্ত মেয়েটির এই কান্ড ? রাত পোহালেই যার বিয়ে । সব দিকে দাওয়াত করা হয়ে গেছে। বর পক্ষকেই বা কি করে মুখ দেখাবো ? তোমাকে আমি কতবার বলেছি কাজলি লজিং মাষ্টার সালামকে ভালো পায় । আমাকে অনেকবার বলেছে সে মাষ্টার ছাড়া আর কাউকে বিয়েই করবে না। ছেলেটা খারাপ না, ছেলেটা তোমারও অপছন্দ ছিল না। সে বলল, ভাবী লকডাউনে ইউনিভার্সিটি বন্ধ। ক্লাশ তো আর হচ্ছে না। রমজান মাসে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি । ঈদের পরেই ফিরব। আর তুলি এই ফাঁকে কাজলির বিয়ে ঠিক করে ফেললে ? ভালো একটা সম্বন্ধ পেলাম তাই রাজি হলাম। এখন বোঝ ? ঠ্যালা সামলাও । মাস্টারের বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ে একবার খোঁজ তো নিতে পার ? বাড়ির ঠিকানা তো জানি না। জানি শুধু রাখালগাছি, বাগেরহাটের রাখালগাছি। এতটুকুন পরিচয়ে কি খোঁজ নেয়া যায় ? খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা আন্তজেলা বাস টার্মিনাল। জেলার ব্যস্ততম বাস টার্মিনাল। এদিক থেকে বাস ঢুকছে তো আরেক দিক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে । কাজলির কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক পৃথিবী । বাড়ির বাইরে সে একা একা কোনদিন যায়নি । সব সময় ভাই বা ভাবীর সাথী হয়ে গেছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় কোন বাসে চড়ে সা্লামের বাড়ি যাবে ? তার চোখে পড়ল একটা বাসের গায়ে লেখা ‘ চৈতি এক্সপ্রেস সোনাডাঙ্গা টু বাগেরহাট ‘ কন্ডাকটর ছেলেটাও মুখে বিরামহীন ভাবে উচ্চস্বরে ডেকে যাচ্ছে বাগেরহাট, বাগেরহাট । কাটাখালি, ন’পাড়া, ষাটগম্বুজ, বাগেরহাট । এখনই ছেড়ে যাবে , আসেন আসেন । কাজলি কন্ডাকটরের কাছে যেতেই সে জিজ্ঞেস করল ,কোথায় যাবেন আফা ? ওডেন, ওডেন । এই বাস কি সিএন্ডবি বাজার যাবে ? ভাই । জ্বী । ওডেন আফা, ওডেন। আপনেরে সিএন্ডবি বাজার নামায়ে দিব। ওডেন। সিএন্ডবি বাজার বাস স্টান্ডে নেমে পড়ল আরেক মুসিবদে। দু'টো ভ্যান রিকশা এবং একটি রিকশা কোনটাই রাখালগাছি যাবে না। কারো ভাড়া আছে, কেউ অন্যদিকে যাবে। অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি রিকশা সেখানে এসে দাঁড়ালো । কই যাবেন আপা ? রাখালগাছি বাজার । যাবেন আপনি ? না, না।, আমি ওই দিকে যাব না । ওই দিকের রাস্তাঘাট আমার জানা নাই । আমি দৌলতপুর থেকে এসেছি । আমার বড় বিপদ, ভাই। আমি রাস্তাঘাট চিনায়ে নিয়ে যাব । চলেন, প্লিজ । রিকশাওয়ালার মনে একটু দরদ হলো, সুন্দরি মাইয়া বিপদে পড়েছে । বাস স্টান্ডে আবার কোন বিপদে পড়ে ! যাই নিয়া। ঠিক আছে আপা, ওঠেন । আল্লাহ ভরসা । রিকশা কিছুদূর যেতেই কাজলি জিজ্ঞেস করল , রাখালগাছি বাজার কতদূর ? অ্যা, বলেন কি আপা ? আপনি না বললেন এলাকা আপনি চেনেন ? আমাকে রাস্তাঘাট চিনায়ে নিয়ে যাবেন। মিছা কথা। অনেকক্ষন রিকশা ভ্যানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কোনটাই এদিকে আসতে রাজী ছিল না। তাই এই পথের আশ্রয় নিয়েছি । আমাকে ক্ষমা করবেন, ভাই । মাথা ঝুকিয়ে সে বলল, আচ্ছা । তা হলে এই কথা । যাক, রিকশায় যখন তুলেছি গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াই আমার দায়িত্ব । আপনি নিশ্চিন্তে বসুন । আপনাকে পৌঁছে দিব । থ্যাঙ্ক ইয়ু,ভাই । থ্যাঙ্ক ইয়্যু । আপনাকে ওয়েলকাম । রিকশাও্য়ালার ভদ্রোচিত কথাবার্তা শুনে কাজলি মনে মনে ভাবল ‘ এ রিকশাওয়ালা অন্য আর আট দশটা রিকশাওয়ালার মত নয় , ব্যতিক্রম । কোন ভদ্র ঘরের সন্তান হবে ? যাক গে । রিকশাওয়ালার চরিত্র নিয়ে থিসিস করার সময় নয় । তার সাথে কী আমি ইয়ে মানে প্রেম করব নাকি ? নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানই এখন মূল লক্ষ্য । আর কত দূর ? ভাই । ধরেন, আর দশ পনের মিনিট । আপনি কি রাখালগাছির সালামকে চিনেন ? তার ছোট ভাইয়ের নাম কালাম। না, চিনিনা । আমাদের বাড়ি এই দিকে না। দড়াটানার ঐপারে । এই দিকে খুব একটা আসা পড়ে না। ও আচ্ছা । আপা আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি । মোড় ফিরলেই রাখালগাছি বাজার । এ অঞ্চলের মিষ্টি খুবই জনপ্রিয় । যে বাড়িতে যাবেন কিছু মিষ্টি নিবেন নাকি ? একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, না ভাই । আমার গন্তব্য অজানা । কোন বাড়িতে যাব তাই-ইতো জানিনা। বলেন কী ? হ্যাঁ ভাই । সে এক ইতিহাস । দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা আমাদের বাড়ি । তিন ভাই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট । বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, ছোট ভাই ব্যাংকে চাকরি করেন ।.পরিবার নিয়ে থাকেন কুষ্টিয়া। আমি যখন মহেশ্বরপাশা গার্লস হাই স্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্রী রাখালগাছির আব্দুস সালাম আমাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। তিনি তখন সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র। তারপর ? অতিমারি করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি যখন বন্ধ রমজানের প্রথম সপ্তাহে তিনি জানালেন ,’ বাকি রমজানটা মা এবং ভাইয়ের সাথে কাটাবেন ‘। ঈদের পরেই আমাদের বাড়ি ফিরে আসবেন । এর মধ্যেই আমার বড় ভাই তার এক বন্ধুর ভাইয়ের সাথে আমার অসম্মতিতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেন । আপনি যে সালাম সাহেবকে ভালোবাসেন আপনার পরিবার জানত না ? হ্যাঁ জানত। ভাবী ভাইয়াকে অনেকবার বলেছেন। তো ভাইয়া কী বলেছেন ? তিনি বলছিলেন, ‘ ছেলেটা লেখাপড়া শেষ করুক । তারপরে দেখা যাবে । এমন সময় রিকশাওয়ালার কোমরে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সে জিজ্ঞেস করল , আপা আমি মোবাইলটা রিসিভ করি ? পরে আপনার কাহিনী শুনছি । জ্বী,করেন । মোবাইলের ঐ প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে, তুমি এখন কোথায় ? আমি রাখালগাছি । রাখালগাছি কেন ? তুমি তো ওই দিকে যাও না। আজকে কেন ? আর বলনা, দৌলতপুর থেকে একটি মেয়ে সিএন্ডবি বাজার এসেছে । তার অনরিকোষ্টে এ দিকে এসেছি । দুপুরে কি কিছু খেয়েছ ? না, খাইনি । আমি গ্রামের ভিতর এখানে রেস্টুরেন্ট পাব কই ? সামনে রাখালগাছি বাজারে পৌঁছে খেয়ে নিব। আচ্ছা খেয়ে নিও । মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে । রাখি, আই লাভ ইউ । ফোনের সব কথোপকথন কাজলি কান পেতে শুনেছিলো। জিজ্ঞেস করল কে ? আমার ফিয়েন্সা । রিকশাওয়ালার মুখে ফিয়েন্সা শব্দটি শুনে চমকে গেল কাজলি। এই শব্দটা ইউরোপ আমেরিকার প্রেমিক প্রেমিকরা ব্যবহার করে যাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কাজলি জিজ্ঞেস করল , ফিয়েন্সা মানে আপনি কি জানেন ভাই ? জানবো না কেন ? না জেনেই কী বলেছি । সে আমার হবু স্ত্রী । আমার পরিবারের সবাই জানে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি । খুব শিগগিরই আমাদের বিয়ে হবে। এবার সে আরো চমকে গেল । জিজ্ঞেস করল, আপনি কে ? আপনার পরিচয়টা কি একটু জানতে পারি, ভাই ? আফসোসের সাথে বলল, পরিচয় জেনে আর কী হবে, আপা ? আমার নাম আবু হানিফ । সুন্দরবন কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে সেখানে বিএতেও পড়েছি এক বছর । সংসারের অভাব অনটনের কথা চিন্তা করে চাকরির জন্য অনেক ইন্টারভিউ ভাইভা দিয়েছি । কোন চাকরি আমার জীবনে ভর করে নি। বর্তমানে বাংলাদেশে ঘুষ ছাড়া কোথাও চাকরি পাওয়া যায় না। বিদেশে গিয়ে আমাদের দেশের অনেকেই টাক্সি-ক্যাব চালায় । আমি দেশে থেকে চালালে অসুবিধা কোথায় ? অবশেষে স্বাধীন পেশায় নেমে পড়লাম । এতক্ষণ পাশাপাশি বসে আসলাম আপনার নামটা কিন্তু জানা হলো না। আমার নাম কাজলি । আপনার নাম তো বলেছেন আবু হানিফ । নাইস টু মিট ইয়্যু, ব্রাদার। থ্যাঙ্ক ইয়্যু । তার পরে বলেন আপনি এই সিএন্ডবি বাজার আসলেন কেন ? আমার অসম্মতিতে ভাইয়া যখন আমার বিয়ে ঠিক করল বাড়ি ছেড়ে পালানো ছাড়া আমার কাছে দ্বিতীয় কোন রাস্তা খোলা ছিল না। তার মোবাইল নাম্বার জানেন না ? জানি, তা বন্ধ। হয়ত ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছেন । না,না । তিনি এমন করতে পারে না, ভাই। আপনি জানেন, একবার আমার জ্বর হয়েছিল । সাত দিন খাওয়ার রুচি ছিল না। সেই সাত দিনই সে রোজা ছিলেন । রোজা রেখেই ক্লাশ করতেন । সেই মানুষটি এমন করতে পারেন না। আমার মন বলছে তিনি কোন বিপদে পড়েছেন । ঠিকানা জানেন ? ঠিকানা শুধু, ‘ রাখালগাছি ।’ এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। সালামের শেষ কথোপকথনের কথাগুলো এ সময় কাজলির হৃদয় পটে ভেসে উঠলো, ‘স্যার শোনেন,দাঁড়ান না । আমার কথাটা একটু শোনেন । আমার কথাটা একটু শুইনা যান । আমারে কিছুই না কইয়া যাচ্ছেন ক্যান ? কোথায়, ক্যান যাচ্ছেন ? কবে আসবেন কিছুইতো কইয়া গ্যালেন না। আরে পাগলি ! আমি কী একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি ? রোজার মধ্যে বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি । ঈদের পরেই ফিরব । ঈদের পরে যদি না আসেন তা হলে আপনেরে আমি কোথায় খোঁজব ? আমি তো আপনার ঘরবাড়ি কিছুই চিনি না। ঘরবাড়ি চেনা লাগবে কেন ? আমি ঈদের পরেই ফিরে আসছি না? যদি না আসেন ? যদি কোন অসুবিধা হয় ? মোবাইল নাম্বার আছে না ? মোবাইলের কোন ভরসা নেই । আপনি আপনার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যান । রাখালগাছি । সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকে বাগেরহাটগামী যে কোন বাসে সিএন্ডবি বাজারে নাইমা আমাদের বাড়ি রিকশা অথবা ভ্যানে যেতে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার পথ । আমার ছোট ভাইয়ের নাম আবুল কালাম । এলাকার সবাই আমাদের চিনে । যাও বাড়ি যাও । মাইনসে দেখলে খারাপ ভাববে । আমি ঈদের পরেই ফিরে আসব। রিকশাওয়ালা আবু হানিফের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো কাজলির। আপা নামেন আমরা এখন রাখালগাছি বাজার। আপনি কোথায় খুঁজবেন সালাম সাহেবকে ? আবু হানিফ বলল, আপনি রিকশায় বসেন । আমি মানুষজনের কাছে জিজ্ঞেস করি কেউ সালাম নামে কাউকে চিনে কিনা ? সে আশপাশের দোকানদার, মানুষজনের কাছে জিজ্ঞেস করল কেউই সন্ধান দিতে পারল না। ফিরে এসে জানালো না আপা কেউ সঠিক সন্ধান দিতে পারল না। এক ব্যক্তি পরামর্শ দিল,সামনে রাখালগাছি ইউনিয়ন পরিষদ অফিস। সেখান গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন ? আচ্ছা চলেন । পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় মেম্বারদের নিয়ে একটি সভায় ব্যস্ত ছিলেন । লক্ষ্য করলেন রিকশায় থেকে নেমে একজন অপরিচিত মেয়ে অফিসের বারন্দায় পায়চারি করছে । চেয়ারম্যান চৌকিদার পাঠিয়ে খোঁজ নিলেন । ফিরে এসে চৌকিদার জানাল, আপনার সাথে দেখা করতে চায় । চেয়ারম্যান তাঁকে ভিতরে ডেকে পাঠালেন । তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন , কী নাম তোমার , বারান্দায় পায়চারি করছিলে কেন ? আমার নাম কাজলি । দৌলতপুর থেকে এসেছি । আপনাদের ইউনিয়নে আব্দুস সালাম নামে কোন যুবক আছেন ? তিনি দৌলতপুর বিএল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তারা দুই ভাই । ছোট ভাইয়ের নাম আবুল কালাম । কেন ? তার সাথে দেখা করা আমার খুবই জরুরি । বাবার নাম কী ? কোন গ্রাম ? বিস্তারিত কিছু জানা নাই । আমাদের ইউনিয়নে ১০ টা গ্রাম । প্রায় ১৮ হাজার মানুষের বাস। বিস্তারিত না পেলে শুধু সালাম কালাম বলে তো কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভব না। তুমি এক কাজ করো, বেটি । ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বের হয়ে ডান দিকে কিছু দূর গেলে পল্লী মঙ্গল গার্লস হাই স্কুল । ঐ স্কুলের পাশের বাড়ির একটা ছেলে বিএল বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ে । করোনার কারণে সে এখন বাড়িতে । তার কাছে খোঁজ নিতে পারো ? সভা থেকে এক লোক বলে উঠলেন,হ্যাঁ,হ্যাঁ তার নামও সালাম। তার কোন ছোট ভাই আছে কি না জানি না। তবে একটা বোন আছে। পরিষদ থেকে বেরিয়ে হানিফ কাজলির দিকে তাকিয়ে কি করবেন, যাবেন ? আমি কি আপনার সাথে থাকব নাকি চলে যাব ? না পেলে তো আবার ফিরে যেতে হবে । আমার তো ফেরার আর কায়দা নাই । বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি । ভাই ভাবী কি আর বাড়িতে উঠতে দিবেন ? থাকি । কাজলি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল থাকলে তো ভালই হয় । তা হলে এক কাজ করি। রিকশাটা ইউনিয়ন পরিষদের ভিতরে কোথাও নিরাপদে রেখে আসি । ঠিক আছে । তাই করেন। নামের সাথে মিল আছে । বাকি পরিচয়ের সাথে তো মিল নাই। সালামের ছোট ভাই কালাম । কেউ তো বলল না কালাম নামে ভাই আছে । আবার বোনও আছে । চলেন , দেখে আসা যাক । বাড়ির আঙিনায় এক কিশোরি ভেজা কাপড় নাড়ছিলো। আবু হানিফ তাঁকে জিজ্ঞেস করল , সালাম ভাই কি বাড়িত আছেন ? আছেন। কই? তিনি মাছের ঘেরে । এমন সময় কাজলি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি তার বইন ? আমার কথা কিছু বলে নাই। আপনি,আপনি কে ? আপনার কথা কিছু বলবেন? হাসিহাসি মুখে বলল, আমি কাজলি । তোমার ভাইয়াকে গিয়ে বল কাজলি এসেছে । আপনারা দাঁড়ান। আমি ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি । একজন যুবকসহ ফিরে এলো কিশোরি । কাজলি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হতাস হলো । তারপরেও জিজ্ঞেস করল, কই , কই সে ? যুবকটি তাঁকে জিজ্ঞেস করল কে ? আপনারা কাকে চান ? সালাম । মানে আব্দুস সালাম । সে বিএল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যুবকটি জবাব দিল, আমিই আব্দুস সালাম । বিএলয়ে পড়ি। কাজলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, না না। ভুল । আমি যে সালামকে খুঁজি এ তো সে নয় । দ্রুত পায়ে রাস্তার দিকে ছুটে গেল । কিশোরিটি তখন মুখ ভেংচিয়ে বলল,চিন্তা কর ভাইয়া,ক্যামন আজাইরা মাইয়া গেরামে গেরামে ঘুইরা জামাই বিচরায় । ধ্যাত, দিলি আজকের দিনটা মাটি কইরা। যাই । ঘেরে লোকজন আবার বাগদা ধইরচে । গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে কোথাও সালামের সন্ধান না পেয়ে অবশেষে হতাস হয়ে আবু হানিফ বলল, দিন তো শেষ এখন কী করবেন ? ফিরে যাওয়াই ভাল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাজলি বলল, ফেরার তো কোন পথ নাই আমার। কম তো খোঁজলেন না। পাওয়া তো দুরের কথা। তার কোন ছায়াও মিলছে না। আমি আপনারে খুব অসুবিধায় ফাল্যায়ে দিলাম ? আমি কী কইছি আমার খুব অসুবিধা হইতাছে ? সামনে ক্ষুদ্র চাকশ্রী গ্রাম । এই গ্রামটাই বাকী, খুঁইজা যাই । দেখেন ভাই, আল্লাহ যখন আপনার মত একজন ভালো মনের মানুষ মিলাইয়া দিছে । দেইখেন তারেও ঠিক ঠিক মিলাইয়া দিব। আবু হানিফ একটু নিরব থেকে বলল, চলেন । হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখা যাচ্ছিল ক্ষুদ্র চাকশ্রী প্রাইমারী স্কুল। এমন সময় স্থানীয় এক পথিকের সাথে দেখা । তাঁকে দেখা মাত্র আবু হানিফ সম্ভাষণ জানালেন, আসসালামু ওয়ালাইকুম। ওয়ালাইকুম সালাম। আপনাকে তো চিনলাম না? আমার নাম আবু হানিফ। বাড়ি বাগেরহাট । কোন বাড়ি যাইবেন ? পথিকের কথা শেষ না হতেই কাজলি জিজ্ঞেস করল, আপনাদের গ্রামে সালাম, সালাম নামের কোন যুবক আছে ? সালাম । জ্বী,সালাম । তার ছোট ভাইয়ের নাম কালাম । হ, সালাম কালাম। তারা তো দুই ভাই ছিল। বেশী দূর না। তর্জনী নির্দেশ করে দেখালো ঐ যে প্রাইমারী স্কুলটা দেখছেন তার পিছনের বাড়িটাই। কাজলি ও আবু হানিফ দ্রুত সেদিকে ছুটে গেল। সারি সারি দুটো কুঁড়েঘর। সামনে খড়ের পালা । বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় ইট বিছানো। বাড়িতে ঢুকতেই অপরিচিত মানুষের সাড়া পেয়ে একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো । ঘরের মধ্য থেকে মহিলা কন্ঠে শোনা গেলো , কালাম দেখত বাবা, কে এলো ? কালাম নামটা শুনে কাজলি ও আবু হানিফ এ ওর মুখোমুখি হাসিমুখে তাকালো । যে , আমরা ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছে গেছি। ঘর থেকে বারো চৌদ্দ বছরের এক কিশোর বেড়িয়ে এলো । পিছে পিছে মধ্য বয়সী এক নারীও । মলিন কন্ঠে আবু হানিফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কারে চাও বাবা ! ঠিক একই সময়ে নজর গেল কাজলির দিকে। চেয়ে থাকলেন অপলক নেত্রে। তার পরে করুন স্বরে বললেন, মাইয়াডা কেডা ? খুব চেনা চেনা লাইগছে । আস্তে আস্তে কাজলির কাছে গেলেন । মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমারে তো আমি দেখছি ? কই দেখেছি, কই দেখছি বলতে বলতে পরক্ষনে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও বলে ঘরে ফিরে গেলেন। এ সময় আবু হানিফ বলল, এ আবার কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম।আল্লায় জানেন । আমি কি আপনারে খুব অসুবিধায় ফ্যালাইয়া দিলাম? এক কথা বার বার কন কেন? আমি কী কইছি আমার অসুবিধা হইতাছে । ঘর থেকে একটি মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ফিরে এসে মোবাইলে ফটো গ্যালারি সার্চ করে বললেন এই যে। পরিচিত মোবাইল ফোন দেখতে পেয়ে এ সময়ে কাজলি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, এইডা, এইডা সালাম ভাইয়ের মোবাইল না ? মহিলা চোখ মুছতে মুছতে বলল , হ, এইডা আমার বাবার মোবাইল। এই মোবাইলের মধ্যে আমি তোমারে কত দেখছি। তোমার কত ছবি তুলছে। তার কোন শ্যাষ নেই ।একটা কইরা দ্যাহাইছে আর কইছে , এই মাইয়াডারে তোমার পছন্দ হয়, মা । পাগল । মা’য়েরে কেউ এই কথা জিগায় ! কাজলি হেসে হেসে জিজ্ঞাস করল, কই, হ্যায় কই ? তুমি তার সাথে দেখা করতে আইছ ? মাথা নেড়ে জবাব দিল, জ্বী। চোখের জল মুছতে মুছতে আস বলে বাড়ির পিছনের দিকে আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে বাগানে সদ্য সমাহিত বাঁশের খাঁচায় একটা কবরে অঙ্গুলি উঁচিয়ে দেখিয়ে বললেন, ঐ যে, ঐ যে আমার বাবা কবরে ঘুমায় বলে কাজলিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন । কাজলিও মহিলাকে জড়িয়ে ধরে মাক করে চিৎকার দিয়ে মুর্ছা গেল । এতক্ষণ ধরে তার চোখে মুখে যে সামান্য আশা ছিল সেটা মুহুর্তের মধ্যেই হারিয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছেলে কালামকে বললেন,তাড়াতাড়ি এক বালতি পানি নিয়ে আয়,বাবা। নাকে মুখে পানি ছিটাইয়া দে। এ সময়ে আবু হানিফ কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, কি করে কী হলো ? দৌলতপুর থেকে বাড়ি ফিরে সালাম বলল, ঢাকায় যাবে । ওদের ছোট মামা ঢাকায় থাকেন । আমি বললাম একা যাবি কেন কালামকেও সাথে নিয়ে যা। বাবা আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়লে কী হবে ? নিয়মিত নামায আদায় করত । মামার বাসা থেকে বাইতুল মোকাররম ঢিল ছোঁড়া দুরত্বের পথ। শুত্রুবার । দুই ভাই এক সঙ্গে জুম্মার নামায আদায় করতে গেল । মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু অধ্যুষিত একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধান বাংলাদেশে আসবেন তা নিয়ে এক দল মুসল্লির সাথে সরকারের বিরোধ চলছিল। নামাযের পরে দিন ঐ মুসল্লিরা সেই রাষ্ট্র প্রধানের আগমনের প্রতিবাদে মিছিলে নামে। সে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। সালাম তখন মসজিদ থেকে বের হচ্ছিল । এ সময়ে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি এসে সালামের বুকে বিঁধে । সে সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পরে । মুসল্লিরা আতঙ্কে দ্বিকবিদিক ছুটতে থাকে । কালামও ছুটে গিয়ে মসজিদের ভিতরে আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সে বাইরে এসে দেখে সালামের নিথর দেহ মসজিদের সিড়ির গোড়ায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে । চোখ মুছতে মুছেতে আরো বললো, আমাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পার ? বাবা ! কেন ? যারা দ্যাশ চালায় তাদের জিগাইতাম , আন্দোলন দমানোর নামে আর কত মায়ের বুক খালি করবে সরকার ? টুপি পড়লে আর নামায আদায় করলেই কী সবাই সন্ত্রাসী হয় ? বিদ্রঃ রচনাটি শুধু মাত্র বিনোদনের জন্য । এটির সাথে জাতি, ধর্ম বা কোন ব্যক্তির মিল নেই । যদি কোন মিল পাওয়া যায় তা সম্পূর্ণভাবে কাকতালীয়।                 সিকদার মনজিলুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক। সম্পাদক-শনিবারের চিঠি    
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!

আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন

খাঁচা
সাহিত্য

খাঁচা

২ সপ্তাহ আগে by বাংলা প্রেস