১৪ অক্টোবর ২০২৫

শেখ হাসিনার 'নিদারুণ ট্রাজেডির' পুরনো ক্যাসেট আর বাজবে না জাতিসংঘে

Logo
বাংলা প্রেস প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৪১ পিএম
শেখ হাসিনার 'নিদারুণ ট্রাজেডির' পুরনো ক্যাসেট আর বাজবে না জাতিসংঘে
  আবু সাবেত:  জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের বক্তৃতায় গত ১৭ বছর ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে 'নিদারুণ ট্রাজেডির' কথা জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতাদের শুনিয়েছেন এবারে সেই পুরনো ক্যাসেট আর বাজবে না ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁর পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার 'নিদারুণ ট্রাজেডির' কথা গত ১৭ বছর ধরে শুনিয়েছেন জাতিসংঘে। ২০২৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা ও বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন আমার মা, আমার তিন ছোট ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূ, চাচাসহ পরিবারের মোট আঠার সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার ছোট বোন এবং আমি বিদেশে থাকায় সেই বর্বরতা থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। এর আগে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লাখ দেশবাসীকে হত্যা করা হয়, দুই লাখ নারী নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। আমি নিজে নিপীড়িত এবং যুদ্ধ ও হত্যার নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যুদ্ধ, হত্যা, অভ্যুত্থান ও সংঘাতের ভয়াবহতার কারণে মানুষ যে বেদনা ও যন্ত্রণা সহ্য করে তা অনুভব করতে পারি। তাই, আজ আপনাদের সকলের কাছে, বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার আবেদন, যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করি। শেখ নোবেল পুরুস্কার পাবার আশায় গত ৬ বছর ধরে জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতাদের শুনিয়েছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে নানা কল্প কাহিনী। কখনও বলেছেন ১৮ কোটি মানুষের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারলে ১০ লাখ রোহিঙ্গার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা কিছুই না। কিন্তু ২ বছর না যেতেই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে বারবার তাগিদ দেন বিশ্বনেতাদের কাছে। ২০২৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে শেখ হাসিনা বলেন, আমি মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচূত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু, পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। বাস্তুচূত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। আসুন আমরা এই নিঃস্ব মানুষের জন্য তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করি। ২০২২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, জনাব সভাপতি, এখন আমি এক নিদারুণ ট্রাজেডির কথা বলবো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই-মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার দশ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা ১৩ বছরের বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের আরিফ সেরনিয়াবাত এবং ৪ বছরের সুকান্ত, আমার ফুফাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ব্রিগেডিয়ার জামিল, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানসহ ঘাতকেরা ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। আমি তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট জার্মানিতে ছিলাম বলে আমার ছোটবোন শেখ রেহানা ও আমি বেঁচে যাই। ৬ বছর রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করে। দুই লাখ মাবোনের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ১৯৭১ সালে আমার পিতাকে গ্রেফতার করার পর পাকিস্তানের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় আমার মা, দুই ছোটভাই শেখ রাসেল ও শেখ জামাল, ছোটবোন শেখ রেহানা ও আমাকে গ্রেফতার করে একটি একতলা স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে রাখে। আমার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ঐ বন্দিখানায় জন্মগ্রহণ করে। আমাদের ঘরে কোন ফার্নিচার দেওয়া হয়নি। সুচিকিৎসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। দৈনন্দিন খাবার পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত। কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই নে, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই। আমার আকুল আবেদন, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই। এসব পুরনো ক্যাসেট আর বাজবে না এবারের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। এবার জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতারা শুনবেন নতুন ক্যাসেটে নতুন কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বীরগাথা তুলে ধরবেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবেন তিনি। ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে এর প্রতিফলন থাকবে। শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের দর্শন বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন অধ্যাপক ইউনূস। গর্বিত ও মর্যাদাশীল হিসেবে দেশের জনগণ বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজেদের কীভাবে তুলে ধরতে চায়, সেটিই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাবেন তিনি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরা হবে। তিনি ভূরাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে উদাত্ত আহ্বান জানাবেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সেসব তুলে ধরা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি আরও কিছু বৈঠকে অংশ নেবেন। বিপি।এসএম
[বাংলা প্রেস হলো মুক্ত চিন্তার একটি বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যম। এটি স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য নিরপেক্ষ সংবাদ, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য সরবরাহ করে। আমাদের লক্ষ্য হলো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, যা আজকের দিনে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।]

মন্তব্য (0)

আলোচনায় যোগ দিন

আপনার মতামত শেয়ার করতে এবং অন্যান্য পাঠকদের সাথে যুক্ত হতে দয়া করে লগইন করুন।

এখনো কোন মন্তব্য নেই

Be the first to share your thoughts on this article!

আপনি এগুলোও পছন্দ করতে পারেন