Home সাহিত্য বাংলাদেশকে নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের নেপথ্য কথা

বাংলাদেশকে নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টের নেপথ্য কথা

by bnbanglapress
A+A-
Reset

নোমান সাবিত: ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজন করা হয় ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আমেরিকার মাটিতে আয়োজিত এই কনসার্টে গায়ক জর্জ হ্যারিসনের অবিস্মরণীয় ‘বাংলাদেশ’ গানটির কথাই সবার আগে মাথায় আসে।
এমন একটি আয়োজনের কথা হ্যারিসনকে বলেছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর। ১৯৬৫ সালের এক রাতে তার সঙ্গে পরিচয় হয় হ্যারিসনের। এরপর প্রায় তিনবছর রবিশংকরের কাছে সেতার বাদন নিয়ে দীক্ষা নেন হ্যারিসন।
হ্যারিসন বিটলস ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন।১৯৭০ এ ভেঙে যায় ব্যান্ড। তারপর বিটলসের সদস্যরা নিজেদের মতো করে ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকেন।
এরপর শুরু হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। রবিশংকরের সূত্রে যুদ্ধের খবরাখবর নিয়মিতই পাচ্ছিলেন হ্যারিসন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণ হ্যারিসনকে বিচলিত করে তোলে। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মানুষের অসহায়ত্বের ব্যাপারটি হ্যারিসন কতটুকু বুঝবেন তা নিয়ে রবিশংকর পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না, কিন্তু সংবেদনশীল হ্যারিসন তীব্রভাবেই সেই ব্যথা অনুভব করতে পেরেছিলেন।
তাই নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে আমেরিকার মাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে কনসার্ট আয়োজনের উদ্যোগ নেন তিনি। এর সঙ্গে যুক্ত করেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটনের মতো শিল্পীদের।
মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে ছিলো না। কিন্তু এই কনসার্ট আয়োজন আমেরিকান নাগরিকদের ভেতর বাংলাদেশ সম্পর্কে সহানুভূতি সৃষ্টি করে।
সে সময় বিটলসের বাইরে একক ক্যারিয়ারে সাফল্যের মুখ দেখেছেন হ্যারিসন। ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ অ্যালবাম তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে গেছে। বিটলসের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হ্যারিসন। রিঙ্গো স্টার ও জন লেনন কনসার্টে আসতে সম্মত হন। পল ম্যাককার্টনি ‘না’ বলে দেন। তবে লেননও পরবর্তীতে তার স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে মতভেদের কারণে কনসার্টে অংশ নিতে পারেননি।
তবে তারা না এলেও বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, আলী আকবর খাঁ, আল্লাহ রাখা-র মতো সঙ্গীতজ্ঞরা ছিলেন।
ভারতীয় শিল্পীরা অপরিচিত হলেও নিউইয়র্ক টাইমসের পাতায় বিজ্ঞাপন দেখে আমেরিকানরা খুবই উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ৪০ হাজার টিকেট বিক্রি হয়ে যায় মাত্র ৬ ঘণ্টায়। স্থানীয় সাংবাদিকেরা দেন ১২ হাজার ডলার অনুদান।
জুলাইয়ে কনসার্ট পূর্ব এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কনসার্টের উদ্দেশ্য নিয়ে হ্যারিসন জানান, ‘ আমার বন্ধু (রবিশংকর) আমার কাছে সহায়তা চেয়েছে, আমার মনে হয়েছে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা চিন্তা করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করেননি তিনি। বলেছিলেন কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থী শিশুদের কাছে পাঠানো হবে। কনসার্টের পোস্টারে ও রেকর্ড লেবেলেও শিশুদের ছবিই ব্যবহৃত হয়।
১৯৭১ সালের ১ লা আগস্ট মেডিসন স্কয়ারে কনসার্টের আগেই কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় সব জায়গা। হ্যারিসন প্রথমেই রবিশংকর সহ ভারতীয় শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। রবিশংকর আয়োজন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে পরিবেশনা শুরু করেন। উত্তাল তারুণ্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে তাদের ‘বাংলা ধুন।’ এটি ছিলো রবিশংকর ও আলী আকবর খাঁর সেতারের যুগলবন্দী পরিবেশনা। আল্লাহ রাখা (তবলা) ও কমলা চক্রবর্তী (তানপুরা) তাদের সঙ্গে সঙ্গত করেছিলেন।
বব ডিলার পাঁচটি ও জর্জ হ্যারিসন আটটি গান করেন। এর ভেতর একটি ছিলো তাদের দ্বৈত পরিবেশনা। লিওন রাসেল একটি একক ও ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেন। রিঙ্গো স্টার৷ ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেন। পুরো কনসার্টজুড়ে গিটারে অসাধারণ মূর্ছনা তুলেছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন।
বিপুল শ্রোনুকূল্যের ফলে এই আয়োজন সেদিন পরিবেশিত হয়েছিলো দুবার। জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় বাংলাদেশ গান দিয়েই সমাপ্তি টানা হয়েছিলো এই কনসার্টের।
বিশ্বের বহু দেশে বহু কনসার্ট আয়োজিত হয় আর্তমানবতার সেবায়। তবে সেসবের পথিকৃৎ হয়ে আছে এই কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ড ফর ইউনিসেফের সাবেক সভাপতি চার্লস জে. লিওনাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, কনসার্টের টিকেট বিক্রি থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার উঠে এসেছিলো। এই টাকার পুরোটাই জর্জ হ্যারিসন তুলে দেন মুজিবনগর সরকারের হাতে।
হ্যারিসন তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘আই,মি, মাইন’ এ এই কনসার্টের নেপথ্যের ঘটনাগুলো সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ১৯৭০ এ যখন হ্যারিসন তার রাগা ধাঁচের অ্যালবামের কাজ শুরু করেন, তখনই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্ধস্ত উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য রবিশংকর কিছু করতে চেয়েছিলেন। তবে তখন আর এমন কোনো কনসার্ট করা হয়নি। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করার নিমিত্তে আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’
বর্তমানে চ্যারিটি / বেনেফিট কনসার্টের সঙ্গে আমরা খুব ভালোভাবেই পরিচিত। কয়েকদিন আগে ঢাকাতেও ফিলিস্তিনের পক্ষে হয়ে গেলো এমন কনসার্ট। এ ধরনের কনসার্টগুলোর আদিপিতা হ্যারিসন-রবিশংকরের সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ তাই ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর প্রয়াত হ্যারিসন বারবার আমাদের স্মৃতিতে ফিরে আসেন এই কনসার্টের মাধ্যমেই। তার পুণ্য স্মৃতির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।

You may also like

Leave a Comment

কানেকটিকাট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বৃহত্তম বাংলা অনলাইন সংবাদপত্র

ফোন: +১-৮৬০-৯৭০-৭৫৭৫   ইমেইল: [email protected]
স্বত্ব © ২০১৫-২০২৩ বাংলা প্রেস | সম্পাদক ও প্রকাশক: ছাবেদ সাথী