নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপির আগামী নেতৃত্ব কী হবে, তা এখনো শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অগোচরে। দলের নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। নেতাদের বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার দলের দায়িত্বে ফিরতে পারবেন কিনা- এমন শঙ্কা থেকে দলটির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কার হাতে যাবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হয়তো সক্রিয় রাজনীতিতে আর না-ও ফিরতে পারেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে এখন দলের ‘সম্পূর্ণ’ দায়িত্বপালন করছেন। আপাতত তারও দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। লন্ডন থেকে দল চালালেও ঢাকায় তার ভবিষ্যৎ ‘প্রতিনিধি’ কে হবেন তা নিয়ে দলের ভেতরে নানা আলোচনা আছে। কখনো শোনা যায় তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান দেশে ফিরে স্বামীর নির্দেশনা অনুযায়ী দল চালাবেন। কখনো তাদের কন্যা জাইমা রহমান দেশে আসবেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়।
এমন বাস্তবতায় আজ ১ সেপ্টেম্বর ৪৩ বছরে পা রাখল বিএনপি। রাজনৈতিক নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪২ বছর অতিক্রম করেছে দলটি। এর মধ্যে অনেক বাধা এসেছে, একাধিকবার দল ভেঙেছে। তার পরও দেশের অন্যতম বৃহৎ দল হিসেবে টিকে আছে বিএনপি।
দেশে করোনা বিস্তারের পর গত ২৫ মার্চ আকস্মিক খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর তার ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরই মধ্যে স্থায়ী জামিন ও বিদেশে চিকিৎসার আবেদনও করা হয়েছে। স্থায়ী জামিন পেলেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবেন না। কারণ তার জামিন শর্তে তা বলা আছে। এ কারণে দলের সব কার্যক্রম এখন তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই চলছে। বিদেশে থাকলেও তার নেতৃত্বে চলবে দল। খালেদা জিয়া সক্রিয় না হলে দলের কার্যক্রম এভাবেই চলবে নাকি আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী কাউন্সিলে দলের নেতৃত্ব নেবেন তারেক রহমান- এমন প্রশ্নে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা কথা সামনে আসছে।
তবে দলের সিনিয়র নেতারা চান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল পরিচালিত হোক; অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত। কারণ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তারেক রহমানের মানসিক দূরত্ব আছে। তার অনেক সিদ্ধান্ত সিনিয়র নেতাদের পছন্দ নয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কয়েকজন সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অনুরোধও করেছেন।
দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমান চান খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। তিনি আপাতত লন্ডনেই থাকুন। দলের কার্যক্রম তার (তারেক) নেতৃত্বে যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে। অর্থাৎ দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে এখন থেকে তার নেতৃত্বে দল পরিচালিত হোক।
তবে তারেক রহমানের স্ত্রী বা কন্যা রাজনীতিতে এলে তা স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবেন সিনিয়র নেতারা। তারা মনে করেন, নানা কারণে তারেকের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। ‘স্বাভাবিক অবস্থায়’ তার দেশে ফেরার সম্ভাবনাও নেই। এতে দেশে দলের অভ্যন্তরে এক ধরনের নেতৃত্ব সংকট তৈরি হতে পারে। তাই খালেদা জিয়ার পাশাপাশি থেকে তারেক রহমানের স্ত্রী বা কন্যাকে নেতৃত্বে আনা যেতে পারে। তবে তারেক রহমানর ঘনিষ্ঠ নেতারা বরাবরই এমন চিন্তার বিরোধী।
দলের ভেতরের এমন হিসেব-নিকেশের দিকে না এগিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৩ বছরের অধিক সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি রাজনীতির মাঠে কঠিন সময় পার করেছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত কারাগারে পাঠান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাও তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকা খালেদা জিয়ার সাজা সরকারের নির্বাহী আদেশে স্থগিত হলে তিনি মুক্তি পান। অসুস্থতা ও আইনি জটিলতায় রাজনীতি থেকে তিনি এখন দূরে রয়েছেন। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে দলের মূল নেতা হয়ে উঠেন তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তিনি দল পরিচালনা করছেন। তার নেতৃত্ব অনেকেরই মনপুত না হলেও বাধ্য হয়ে তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। দলের মধ্যে প্রচার আছে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বেশিরভাগই প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে দলীয় রাজনীতিতে সিনিয়র নেতাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও রয়েছে দ্বিধা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপির মূল চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। দলের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের নানা নিপীড়ন-নির্যাতনেও দলটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব। চলমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই এটিকে সম্ভব করতে হবে, সে চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, কোনো বার্ষিকীই শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি পালিত হয় গত এক বছরে কী করেছে আগামী বছরে কী করা উচিত বা করতে পারে। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হতে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের জন্য আগামী বছরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ, যে কারণে ত্যাগ এত বছরে সে আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারলাম কিনা। স্বাধীনতার ৫০ বছরের অনুষ্ঠানে আমাদের শপথ হোক যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়াই করেছিলাম, সেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি সব ধর্মের মানুষের দল এটি প্রমাণিত। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার গণতান্ত্রিক মানুষ। একইভাবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই রাজনীতি করেন। এ দল ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্বাস করে ধর্ম ঐতিহ্যের অবিভাজ্য অংশ। বিএনপি হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল চিন্তার একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে- এ স্বাধীনতায় বিএনপি বিশ্বাস করে। সে পথেই বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে। আমরা যদি সতর্ক থাকি কোনো ষড়যন্ত্র কাজে দেবে না।
দলটির নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল পুনর্গঠনের কথা বললেও পকেট কমিটি ছাড়া তেমন কাক্সিক্ষত সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। লম্বা সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতৃত্বের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বারবার হতাশা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হওয়া। সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং নির্বাচনপরবর্তী কৌশল ঠিক করতে ব্যর্থ হওয়া। ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করলেও কোনো কর্মসূচি না দেওয়া, পরে সংসদে যোগ দেওয়া নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই। দলীয় প্রধানের মুক্তির বিষয়ে ছিল না রাজপথে কার্যকর কর্মসূচি। এ সব কারণে মাঠপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ হতাশা থেকে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে না পারার মূল কারণ নিরপেক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব।
বিপি,এসএম