ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বাথপুকুরিয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তির বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধি ভাতার টাকা নগদ একাউন্ট থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকা উদ্ধারের দাবী তারা শনিবার ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের দারস্থ হন। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করে প্রাথমিক ভাবে সত্যতা পেয়েছেন। ভাতাভোগীদের অভিযোগ স্থানীয় সাগান্না ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল ওহাবের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত রাজন নামে এক কলেজ ছাত্র এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন।
ডাকবাংলা বাজারের নগদ এর এজেন্ট হবিবুর রহমানও স্বীকার করেছেন রাজন মাঝেমধ্যে এসে ভাতাভোগীদের টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা পুলিশ ফাড়ির এএসআই মাখন বিশ্বাস জানান, ভাতাভোগী নুরুল ইসলাম, ফেরদৌসি খাতুন, নুর আলম ও বাবুল হোসেন ভাতার টাকা না পেয়ে থানায় অভিযোগ করেন।
বিষয়টি তিনি সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছেন বাথপুকুরিয়া গ্রামের প্রায় ৬/৭ জন বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধি তাদের ভাতার টাকা পাননি। বিষয়টি প্রযুক্তিগত ও জটিল হওয়ায় তিনি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে ভুক্তভোগীদের শনিবার থানায় ডেকে তাদের বক্তব্য শোনেন। ভাতাভোগীরা ইউপি মেম্বরের সহযোগি বাথপুকুরিয়া গ্রামের শাহিন মিয়ার ছেলে রাজনকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দেন। প্রতিবন্ধি ফেরদৌছি বেগম অভিযোগ করেন, রাজন তাদের বই ও সিমসহ মোবাইল নিয়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে একাউন্টে কোন টাকা নেই। টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলে দুই’শ টাকাও নেয় রাজন।
একই কথা জানান,বাথপুকুরিয়া গ্রামের বিধবা শামারুপ নেছা, একই গ্রামের আছিয়া বেগম, আমেনা খাতুন, প্রতিবন্ধি নুর আলম ও বাবুল। তাদের ভাষ্য কলেজ ছাত্র রাজন টাকা উত্তোলনের কথা বলে নিজেই তাদের টাকা তুলে নিয়েছেন। এই টাকা তুলে সে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছে। আব্দুল খালেক নামে এক প্রতিবন্ধির পিতা জানান, ব্যাংক থেকে যখন টাকা প্রদান করা হতো তখন তাদের কোন টাকা খোয়া যায়নি। মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর তাদের এলাকার বহু মানুষের ভাতা নগদ একাউন্ট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কলেজ ছাত্র রাজন জানান, তিনি কারো টাকা উত্তোলন করেন নি। সামনে নির্বাচন, তাই প্রতিপক্ষরা আমার উপর এ রকম মিথ্যা দায় চাপাচ্ছে। স্থানীয় সাগান্না ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল ওহাব বলেন, আসন্ন ইউপি নির্বাচন নিয়ে দলাদলির কারণে এ ধরণের মিথ্যা অভিযোগ থানায় দেওয়া হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তার ওয়ার্ডেও নগদ একাউন্ট হ্যাক করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে দিনি দাবী করেন। অসহায় এক নারী। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডাকবাংলা পুলিশ ফাড়ির এএসআই মাখন বিশ্বাস জানান, তারা যে টাকা পায়নি এটা সত্য। এই টাকা কি ভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে তা বিষদ তদন্তের বিষয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। উল্লেখ ঝিনাইদহে শত শত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচির টাকা ‘নগদ’ একাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে। একাউন্ট হ্যাক করে কে বা করা হতদরিদ্রদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার রহস্য এখনো সমাজসেবা অধিদপ্তর জানাতে পারেনি। টাকার শোকে হতদরিদ্ররা আহাজারি করলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না।
ঝিনাইদহ শহরের মদনমোহন পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিমল কুমার ঘোষাল (গবি স্যার) অভিযোগ করেন, তার ০১৪০৩-০৫৮৬১১ নাম্বারের নগদ একাউন্ট থেকে বয়স্ক ভাতার টাকা উধাও হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তিনি ঝিনাইদহ সদর থানায় জিডি করেছেন। এখনো কোন প্রতিকার পাননি। শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের হাসি রানী অভিযোগ করেন, তিনি নতুন ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু প্রথম কিস্তির টাকা তিনি পাননি। নগদ একাউন্ট চেক করে দেখেন তার টাকা কে বা কারা তুলে নিয়েছে।
ঝিনাইদহ পৌর এলাকার কালিকাপুর গ্রামের ফারজানা আফরিন এ্যানী জানান, অহসায় প্রতিবন্ধি হিসেবে তিনি প্রতিমাসে ভাতা পেয়ে আসছেন। তিনি নগদ একাউন্ট খোলার পর তার নগদ ০১৯৬৯১৯০১৪৩ নাম্বারের সাড়ে চার হাজার টাকা প্রতিবন্ধি ভাতা আসে। কিন্তু উক্ত টাকা গত ৯ জুলাই কে বা কারা ০১৯০৬৪৯৩৩৯১ নাম্বারে ট্রান্সফার করে নেয়। এ ঘটনায় তিনি ১৯ আগষ্ট ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি জিডি (যার নং ৯৯২) করেছেন। কিন্তু এখনো টাকা ফিরে পাননি।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সারা জেলা থেকে এ রকম শত শত অভিযোগ পাচ্ছি, কিন্তু তাদেরকে কোন সহায়তা দিতে পারছি না। কোন কোন উপজেলায় ৫% থেকে ১০% টাকা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লার ১৩৬ জন বয়স্ক, ৪ জন বিধবা, ২৩ জন প্রতিবন্ধি ও ৪ জনের শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা তাদের নগদ একাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়। এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৪৭ লাখ। অনেক ভাতাভোগীর একাউন্ট খোলার আগেই টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জেলা সমাজসেবা অফিসের হিসাবমতে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে চতুর্থ কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১২ জনের, সদর উপজেলায় ১৭ জনের, কালীগঞ্জে ৭ জনের, হরিণাকুন্ডুতে ১৪ জনের ও ঝিনাইদহ পৌরসভায় ১৫২ জনের উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় কিস্তির টাকা শৈলকুপায় ১৪ জনের, কোটচাঁদপুরে ৫ জনের, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ১৮ জনের, মহেশপুর উপজেলায় ১৫৯ জনের, কালীগঞ্জে ২৮ জনের ও হরিণাকুন্ডুতে ৪৯ জনের নগদ একাউন্ট থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ জানান, নগদ একাউন্ট খোলার পর নগদ কর্মীদের দেওয়া গোপন পিন নাম্বার দিয়ে একাউন্টে প্রবেশ করতে পারেনি ভাতাভোগীরা। সমাজসেবা থেকে এমন অভিযোগ অধিদপ্তরে দিলে সব গোপন পিন ‘অটো রিসেট’ করে দেওয়া হয়। পরে ভাতাভোগীরা গোপন পিন রিসেট করে দেখেন তাদের একাউন্টের টাকা আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, ঝিনাইদহ থেকে ঠিক কত জনের টাকা নগদ একাউন্ট হ্যাক করে তুলে নেওয়া হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা প্রাথমিক ভাবে এক হাজার ভাতাভোগীকে সনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের তালিকা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দিয়েছি। সেখান থেকে নগদ কর্তৃপক্ষের কাছে গেছে।
বিপি/কেজে